হালিমের আরেকবার বিশ্বজয়

>
২২ নভেম্বর, ২০১৫: ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথে আবদুল হালিম। ছবি: সংগৃহীত
২২ নভেম্বর, ২০১৫: ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথে আবদুল হালিম। ছবি: সংগৃহীত
ফুটবল-কসরত করেই ২০১২ সালে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। আবদুল হালিম এবার দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটা কীর্তি গড়লেন! মাথায় বল নিয়ে রোলার স্কেটিং করে ১০০ মিটার দূরত্ব ছুটে গেছেন মাত্র ২৭ দশমিক ৬৬ সেকেন্ডে! ২৫ এপ্রিল হাতে পেয়েছেন গিনেসের সনদও।

লিওনেল মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো—দুনিয়ার সবাই তাকিয়ে থাকে তাঁদের পায়ের জাদু দেখার আশায়। ফুটবল মানেই যে পায়ের জাদু। অথচ বাংলাদেশের আবদুল হালিম ফুটবলে দেখাচ্ছেন মাথার জাদু! মাথা দিয়ে ফুটবল নাচান তিনি। আর এমন ফুটবল কসরত করেই ২০১২ সালে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। হালিম এবার দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটা কীর্তি গড়লেন! গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে সেটাও ঠাঁই পেয়েছে গত ২৪ মার্চে।

২০১১ সালে হালিমের গড়া ওই রেকর্ডের কথা মনে আছে তো? না থাকলে মনে করিয়ে দেওয়া যাবে। তার আগে শুনে রাখুন তাঁর এবারের কীর্তির কথা। এবার আবদুল হালিম মাথায় বল নিয়ে রোলার স্কেটিং করে ১০০ মিটার দুরত্ব ছুটে গেছেন মাত্র ২৭ দশমিক ৬৬ সেকেন্ডে! পৃথিবীতে এই কীর্তি এর আগে কেউ গড়েনি। আরও মজার ব্যাপার হলো, এর আগে কেউ উদ্যোগও নেয়নি এমন রেকর্ড গড়ার ব্যাপারে। হালিম নতুন রেকর্ডটি করলেন গত বছরের ২২ নভেম্বরে, ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ২ ও ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। গত ২৪ মার্চে নতুন এই রেকর্ডটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। বিশ্বরেকর্ড তালিকাভুক্তি ও যাচাই-বাছাইয়ের প্রধান আন্তর্জাতিক এই সংস্থার ওয়েবসাইটে (http://goo.gl/zqu 23q) গেলেই দেখবেন লেখা আছে বাংলাদেশের হালিমের নাম।

আবদুল হালিম মাগুরার মানুষ। থাকেন শালিখা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম ছয়ঘরিয়ায়। মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অভিনন্দন জানানোর পর খুশিই হলেন মনে হয়। বললেন, ‘ভাই, এখন একটু ব্যস্ত আছি। চারটার দিকে ফোন করেন।’ তা-ই করা হলো। হালিম বোধ হয় এবার আরাম করে বসে কথা বলছেন, ‘হ্যাঁ ভাই, বলেন এবার।’

জানতে চাওয়া হলো, নতুন রেকর্ড করে কেমন লাগছে? উত্তরে বললেন, ‘দোয়া রাখবেন, নতুন আরও অনেক রেকর্ড করার ইচ্ছা আছে! আমি তো আরও কম সময়ে রেকর্ডটা করতে পারতাম। কিন্তু নানান ঝামেলা থাকায় সেটা হয় নাই। যেদিন রেকর্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম, তার পরের দিনই ছিল হরতাল। খুব সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’

সমস্যা কখনোই পিছু ছাড়েনি হালিমের। ২০১১ সালের ২২ অক্টোবর বল মাথায় নিয়ে নিজেকে বিশ্বসেরা প্রমাণের পরীক্ষায় নামেন তিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বল মাথায় নিয়ে হেঁটেছিলেন ১৫ দশমিক ২ কিলোমিটার পথ। ৩৮ ল্যাপে ওই দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় নিয়েছিলেন ২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি হালিমের বিশ্বরেকর্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে গিনেস কর্তৃপক্ষ। আর তাদের ওয়েবসাইটে হালিমের নাম যুক্ত হয় ২৪ জানুয়ারিতে।

সমস্যার কথা হচ্ছিল। সেবারও অসুস্থ ছেলের চিন্তা এক পাশে রেখে হালিম মাথায় তুলে নিয়েছিলেন ফুটবল। বলা বাহুল্য, বেশ ভালোভাবেই নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছিলেন অবশেষে। তবে তাঁর ছেলে, মানে সুমন হোসেন এখনো অসুস্থ। ২০১১ সালের মতো এবারও হালিমকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে নতুন রেকর্ড করার জন্য।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের দুটি স্বীকৃতি হাতে আবদুল হালিম । ছবি: সংগৃহীত
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের দুটি স্বীকৃতি হাতে আবদুল হালিম । ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে আবারও বিশ্বজয়
রেকর্ডের জন্য এত কষ্ট? কষ্টই বটে! রেকর্ড স্থাপনের জন্য গিনেসের কিছু নিয়ম আছে। রেকর্ড স্বীকৃতির জন্য গিনেস বিচারকদের দৈনিক সাড়ে চার হাজার পাউন্ড ফি পরিশোধ করলে তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে রেকর্ড দেখে ঘোষণা করতে পারেন। অথবা প্রথম দফায় কর্তৃপক্ষ ছয়-সাত সপ্তাহ নির্দেশনা দেয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী করতে হয় সব কাজ। দ্বিতীয় দফায় ৪৯ দিনের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করার নিয়ম। তারপর রেকর্ডটি গড়ার ভিডিও ফুটেজ ধারণ ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে পাঠাতে হয় গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে। এ জন্য কোনো টাকাপয়সা দিতে হয় না। প্রথমবারের মতো এবারও দ্বিতীয় পন্থাটাই বেছে নিয়েছিলেন হালিম। বলছিলেন, ‘বছর দুয়েক আগে গিনেস কর্তৃপক্ষকে নতুন রেকর্ডের কথাটা জানাই। আমি চেয়েছিলাম ৪০০ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করব। কিন্তু ওরা বলল, আপনি ১০০ মিটারই করেন। কারণ, এই রেকর্ডটাই এর আগে কেউ করে নাই।’
গিনেসের নির্দেশনা অনুযায়ী সব মেনে স্থানীয় পর্যায়ে একটি কমিটিও গঠন করেন হালিম। কমিটিতে টাইমকিপার হিসেবে ছিলেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের প্রশাসক মো. ইয়াহিয়া ও জাতীয় অ্যাথলেট মোশতাক আহমেদ। সাক্ষী হিসেবে ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা শেখ ফারুক হাসান ও বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামান ও সার্ভেয়ার মো. জাহিদ হাসান। হালিমের বিশ্বজয়ের ভিডিও ফুটেজ ধারণ করা হয় ওই কমিটির সামনে। স্থান ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। কিন্তু এতশত মাঠ থাকতে সেখানে কেন? হালিমের জবাব, ‘রোলার স্কেটিংয়ের জন্য সমতল জায়গা দরকার। তাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মই উপযুক্ত মনে হয়েছে আমাদের কাছে।’

ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে লেগেছিল সাত দিন। এরপর গত ২৩ মার্চ এল সুখবর। আর গত ২৫ এপ্রিল গিনেস কর্তৃপক্ষ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে বিশ্বরেকর্ডের সনদ।

তবে এই অর্জনের পেছনের লড়াইটা কেবলই হালিমের। রেকর্ড স্থাপনের নিয়মকানুন মানতে গেলে প্রয়োজন বেশ কিছু টাকার। সেই টাকা জোগাড় করতে কম গলদঘর্ম হতে হয়নি তাঁকে। অবশেষে এগিয়ে এসেছিল ওয়ালটন। হালিম বললেন, ‘যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার, উপমন্ত্রী আরিফ খান, সাংবাদিক রায়হান আল মুঘনির কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আমি। ওয়ালটন কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ধন্যবাদ। আসলে সংসার চালাতেই হিমশিম খাই, তার ওপর ছেলেটা অসুস্থ। ওকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। টাকার অভাবে সেটা আটকে আছে। সব মিলিয়ে রেকর্ডটা যে শেষমেশ করতে পেরেছি, এটা একটা বড় ব্যাপার।’

তবুও দারিদ্র্য

ফুটবলের কসরত দেখানোই আবদুল হালিমের পেশা। তবে এতেও মন্দা যাচ্ছে আজকাল। বয়স এখন ৪১। স্ত্রী ও দুই কিশোর ছেলেকে নিয়ে সংসার। যে মানুষটা ফুটবলের ভারসাম্য রক্ষায় পটু, সেই তিনিই জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছেন প্রতিনিয়ত! এত কিছুর পরও স্বপ্ন দেখেন, আরও নতুন সব রেকর্ড করবেন। দেশের জন্য বয়ে আনবেন গৌরব। আরেকটা স্বপ্ন আছে হালিমের। শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমি তো দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছি। স্বপ্ন দেখি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব। তিনি যদি একটু সহযোগিতা করেন, তাহলে নতুন রেকর্ডগুলো করা অনেক সহজ হবে। সংসারে টানাটানি দূর হবে, ছেলেটার চিকিৎসা করাতে পারব...।’