তিনি যদি আরও কয়েকটা গান দিয়ে যান...

এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর

বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। কাব্য, গদ্য, নাটক, গল্প-উপন্যাস, চিত্রনাট্য, গান—লেখালেখির সব শাখায় শক্তিশালী লেখনী তাঁর। বাবা সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে লিখেছেন তাঁর ছেলে দ্বিতীয় সৈয়দ–হক এটি এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।
পাশাপাশি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা মঞ্চনাটক, চিত্রনাট্য ও গানে কাজ করার অনুভূতি লিখেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, কবরী এন্ড্রু কিশোর

সৈয়দ শামসুল হক, সবার প্রিয় হক ভাই, আমার কাছে তিনি সাধারণ কোনো কবি-সাহিত্যিক নন, তিনি অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে একজন। তাঁর প্রতি আমার সম্মান ও শ্রদ্ধার জায়গাটা কাজ করত অন্য রকমভাবে। তাঁর গাওয়ানো কয়েকটি গান করা ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার কোনো স্মৃতি নেই। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা যে করব, সেই সাহসও দেখালাম না। এটা একেবারে শ্রদ্ধার জায়গা থেকে।

হক ভাইয়ের লেখা প্রথম গান গাওয়ার সুযোগটা হয় ১৯৮২ সালে। বড় ভালো লোক ছিল সিনেমায় সেই গানটি হচ্ছে ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’। আলম খান ভাইয়ের সুর করা এই গানটির রেকর্ড করি শ্রুতি স্টুডিওতে। গানটি গাওয়ার সময় হক ভাইয়ের সঙ্গে আমার সেভাবে কোনো পরিচয়ও ছিল না।

এই গানটা আমার জীবনের একটি অবিস্মরণীয় গান। এই গানের জন্য আমি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই ১৯৮২ সালে। হক ভাই তখন গান লিখতেন না। এই সিনেমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘শাওন সাগর’ সে সময় বেশ নামকরা ছিল। তাদের বেশির ভাগ ছবিতে নান্দনিকতাও ছিল। এই সিনেমার পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেব একজন অধ্যাপক ছিলেন। সবাই তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করত। বয়স অনেক হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা করা হলো। যেটা দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া যাবে, যাতে শেষ বয়সে উনি পুরস্কার ও সম্মান পান। আর সত্যি সত্যি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিল এই ছবি। সে হিসেবে হক ভাইকে গান লিখতে দেওয়া হয়েছিল।

আমার এখনো মনে আছে, আমি তখন আলম ভাইয়ের বাসায় বসে আছি, হঠাৎ এই গানটি নিয়ে উপস্থিত হলেন হক ভাই। গানটি দিয়ে বললেন, ‘আলম সাহেব গান তো লিখতে বলেছেন। কিন্তু গান তো লিখি না আমি। লিখতে চাইও না। কারণ, যা–ই লিখতে যাই তা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন লিখে শেষ করে ফেলেছেন! আর যদি নতুন কিছু না দিতে পারি, তাহলে তো লিখে লাভ নেই। আমি অনেক চিন্তা করে একটা ছোট্ট জিনিস লিখে এনেছি, জানি না এটা আপনার কেমন লাগবে। তবে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল—কেউই এই শব্দগুলো তাঁদের গানে ব্যবহার করেননি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি গানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারি, তাহলে এই গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার দিতে বাধ্য। কারণ, এ ধরনের গানের কথা আগে হয়নি। আপনি যদি আমার চাওয়ামতো সুর করতে পারেন, তাহলে আপনিও পুরস্কার পাবেন। আর আপনি যাঁকে দিয়ে গাওয়াবেন, তাঁর শতভাগ লাগবে না, যদি মোটামুটিও গাইতে পারে, তাহলে সেও জাতীয় পুরস্কার পাবে নিশ্চিত।’

অবাক করা বিষয় হলো, গানটি গাওয়ার পর শামসুল হক ভাইয়ের সব কথা সত্যি ফলে গিয়েছিল। গানটা রিলিজের পর আমি কলকাতা ও মুম্বাই গিয়েছিলাম। সেখানে যখন বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হলো, দুজনই আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তাঁদের কথা হলো, তাঁরা দুই গীতিকার আধুনিক গান নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, তবু গানে এসব শব্দ (ঠুস, হুঁশ, ফুস, ভুশ) তাঁরা খুঁজে পাননি এবং যাঁদের বাংলা সাহিত্যের দিকপাল ভাবা হয়, তাঁরাও এসব শব্দের ব্যবহার করেননি। ‘তো, এই গীতিকার ছেলেটি কে?’ প্রশ্ন করলেন। আমি হেসে বললাম, ‘ছেলেটা না, উনি একজন ভদ্রলোক। আমাদের দেশের প্রখ্যাত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।’

শ্রুতি রেকডিং স্টুডিওতে গানটা রেকর্ড করা হয়। গানটা গুরুত্বপূর্ণ এটা ঠিকই ভেবেছি, কিন্তু এতটা আলোড়ন তুলবে তা চিন্তা করিনি। আমাকে দিয়ে যে গানটা গাওয়ানো হবে এটাও জানতাম না। এরপর হক ভাইয়ের লেখা আরও তিনটি গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। শেষ যে গানটি গেয়েছিলাম, তা হচ্ছে, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা।’

 পরিশেষে বলতে চাই, হক ভাইকে শতকোটি সালাম ও প্রণাম। আমার একটা অদৃশ্য চাওয়া হচ্ছে—তিনি যদি আমাদের আরও কয়েকটা গান দিয়ে যান, তাহলে আমরা নিজেদের আরও কিছু ভালো কাজের অংশ মনে করতে পারতাম।

অনুলিখন: মনজুর কাদের