আইএসের দায় স্বীকার

>

হামলাকারী ৫২ বছর বয়সী খালিদ মাসুদ জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক
পার্লামেন্ট অধিবেশনে এমপিরা

যুক্তরাজ্যের লন্ডনে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে হামলা চালানো ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করেছে পুলিশ। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক ওই ব্যক্তির নাম খালিদ মাসুদ। হামলার পর লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে তিন নারীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে এ হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটস (আইএস)। তারা বলেছে, খালিদ তাদের যোদ্ধা।

পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন চলাকালে গত বুধবার দুপুরে হামলায় এক পুলিশ সদস্যসহ চারজন নিহত হন। আহত হন প্রায় ৪০ জন। তাঁদের মধ্যে ২৯ জন হাসপাতালে আছেন। এর মধ্যে দুজনের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে গতকাল জানানো হয়।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে গতকাল পার্লামেন্টে বলেছেন, সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাজ্য ভীত নয়। আর বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন বলেন, ভয়ে বিভক্ত নয়, বরং মানবতা আবারও তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করেছে।

হামলাকারী খালিদ মাসুদ সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, কেন্টে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি সর্বশেষ পশ্চিম মিডল্যান্ডে থাকতেন। হামলায় ব্যবহৃত গাড়িটি ভাড়া নেন ‘এন্টারপ্রাইজ’ নামে বার্মিংহামে গাড়ি ভাড়া দেওয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের স্প্রিং হিল ডিপো থেকে। এ সময় তিনি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দেন।

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি কমিশনার জানান, হামলাকারী একজনই ছিলেন বলে মনে হচ্ছে। এই হামলার ঘটনা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত বলে তাঁরা মনে করেন।

হামলাকারী খালিদ মাসুদ এর আগে বিভিন্ন ধরনের ছোট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো ফৌজদারি অভিযোগে এবং ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ছুরি রাখার দায়ে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তবে তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের কোনো অভিযোগ ছিল না। তিনি যে এমন হামলা চালাতে পারেন, এমন আশঙ্কাও পুলিশ করেনি।

তবে গতকাল সংসদে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে হামলার বিস্তারিত তুলে ধরে জানান, উগ্রবাদের অভিযোগে কয়েক বছর আগে হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে নজরদারিতে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি।

হামলাকারী খালিদ মাসুদ বুধবার দুপুরে পার্লামেন্টের পার্শ্ববর্তী ওয়েস্টমিনস্টার সেতুর ওপর পথচারীদের গাড়িচাপা দেওয়ার পর পার্লামেন্ট চত্বরের সীমানাবেড়ায় ধাক্কা দেন। সেখানে তাঁর ছুরিকাঘাতে পুলিশ সদস্য কিথ পালমার মারা যান। এরপর নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত হন হামলাকারী খালিদ মাসুদ। নিহত অন্য দুজন হচ্ছেন ওয়েস্টমিনস্টার এলাকার একটি কলেজের কর্মী আয়শা ফ্রেইড ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটক কার্ট কোচরান।

এর মধ্যে বিয়ের ২৫ বছর পালনের অংশ হিসেবে স্ত্রী মেলিসা কোচরানকে নিয়ে লন্ডনে শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন মার্কিন নাগরিক কার্ট কোচরান। খালিদের গাড়িচাপায় বেঘোরে প্রাণ হারান কার্ট। আর গুরুতর আহত মেলিসা এখন হাসপাতালে।

বুধবারের এত বড় ঘটনার পরও প্রতিদিনকার মতো গতকাল কর্মব্যস্ত ছিল লন্ডন। পাতাল ট্রেনগুলোতেও সকালে কাজে ছোটা মানুষের ভিড়। দেখে বোঝার উপায় নেই এক দিন আগেও শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঘটে গেছে ভয়ানক সন্ত্রাসী হামলা। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, চিরচেনা উচ্ছ্বাসের কিছুটা ঘাটতি যেন লন্ডনবাসীর চোখে-মুখে।

ট্রেন ওয়েস্টমিনস্টার স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই অবশ্য ঘোষণা এল স্টেশন বন্ধ। নামতে হলো পরের স্টেশন সেন্ট জেমসেস পার্কে। সেখান থেকে হেঁটে পার্লামেন্ট এলাকার দিকে কয়েক মিনিট যেতেই পুলিশের কড়া উপস্থিতি, ফিতা টেনে রাস্তা বন্ধ করা। প্রতিবন্ধকতার ওপারে যত দূর চোখ যায়, তার পুরোটাই জনমানবহীন। গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টার ছবি এটি।

আগের দিন পুরো শহর সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেও পরদিনই বসল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন। সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাজির হন এমপিরা। এখানেই বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত তাঁরা অবরুদ্ধ ছিলেন। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গতকালের অধিবেশন। আর ট্রাফালগার স্কয়ারে সমবেত হয়ে মোম জ্বেলে ও ফুল দিয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করেন লন্ডনবাসী এবং পর্যটকেরা। শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।

প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, ‘গতকালের (বুধবার) সন্ত্রাসী হামলা আমাদের গণতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রতিদিনের মতো এখানে হাজির হয়েছি। সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাজ্য ভীত নয়। সন্ত্রাসীরা এমন জায়গায় আঘাত করেছে, যেখানে দুনিয়ার নানা জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ স্বাধীনতা উদ্‌যাপন করতে আসে।’ এই হামলাকে বিশ্বের সব স্বাধীনচেতা মানুষের ওপর হামলা বলে আখ্যায়িত করেন থেরেসা মে।

পার্লামেন্টে বিরোধীদলীয় নেতা জেরেমি করবিন হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘ভয়ে বিভক্ত নয়; বরং মানবতা আবারও আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছে। সহমর্মিতা, ঐক্য ও মানবতার মূল্যবোধ বিষাক্ত ঘৃণা ও বিভাজনকে পরাস্ত করবে।’

লেবার দলীয় এমপি খালিদ মাহমুদ পার্লামেন্ট অধিবেশনে বলেন, ‘হামলাকারী আমার সম্প্রদায় কিংবা আমার ধর্মের হতে পারে না। ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ এমন জঘন্য কাজ করতে পারে না।’

স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট অধিবেশনে লন্ডনে হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সেখানে স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিয়ন বলেন, সন্ত্রাসী হামলার দায় কোনো একক ধর্ম বা বিশ্বাসের নয়। বরং এ দায় হামলাকারীর। তিনি অধিবেশন নিয়মিত করায় ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টের এমপিদের সাহসিকতার প্রশংসা করেন।