এ বছরের তাক লাগানো যত আবিষ্কার
প্রাচীন সবকিছুর সঙ্গেই মিশে থাকে কোনো না কোনো কাহিনি। এমন কিছু খুঁজে পাওয়া মানেই সেই কাহিনি নতুন করে সামনে উঠে আসা, নতুন ইতিহাসের উন্মোচন ঘটা। আর তা যদি হয় আলোড়ন ফেলে দেওয়ার মতো কিছু, তবে তো কথাই নেই। চলতি বছরও সাড়া ফেলে দেওয়ার মতো কিছু প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাইজেন্টাইন আমলের আংটি থেকে শুরু করে আস্ত নগর পর্যন্ত।
২০২১ সালে খুঁজে পাওয়া এমন কিছু প্রাচীন নিদর্শনের তালিকা প্রকাশ করেছে সিএনএন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
বাইজেন্টাইন আমলের সোনার আংটি
সোনার আংটি। ওপরে বেগুনি রঙের পাথর বসানো। হাজার বছরের পুরোনো এ আংটির খোঁজ পাওয়া গেছে ইসরায়েলের ইয়াভনে শহরে। গত নভেম্বরে আংটিটি পাওয়ার খবর সামনে আনে ইসরায়েলের পুরাকীর্তি বিভাগ। ধারণা করা হচ্ছে, মূল্যবান আংটিটির মালিক ছিলেন বাইজেন্টাইন শাসনামলের কোনো এক ধনাঢ্য ব্যক্তি। তৃতীয় থেকে সপ্তম শতকের মাঝামাঝি কোনো এক সময় ইসরায়েলে বসবাস করতেন তিনি।
রেমব্রান্টের হারানো চিত্রকর্ম
শিশু ‘যিশুখ্রিষ্টের’ সঙ্গে প্রথমবারের মতো দেখা করতে এসেছেন তিন ব্যক্তি। ইতালির একটি গ্রামের দেয়ালে টানানো ছিল এই সাক্ষাতের ওপর একটি চিত্রকর্ম। ২০১৬ সালে মেঝেতে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি। পরে মেরামত করতে গিয়ে সামনে আসে অবাক করা তথ্য। জানা যায়, সেটি আদতে সাধারণ কোনো চিত্রকর্ম নয়। চলতি বছরে এসে ইতালির হেরিটেজ ফাউন্ডেশন বলছে, এটি বিখ্যাত চিত্রকর রেমব্রান্টের সৃষ্টি—নাম ‘দ্য অ্যাডোরেশন অব ম্যাজাই’। ১৬৩২ থেকে ১৬৩৩ সালে এটি আঁকা হয়। অনেক বছর ধরেই সেটির কোনো সন্ধান মিলছিল না।
মরুভূমির বুকে হারানো আস্ত নগর
মিসর মানেই প্রাচীন নিদর্শনের খনি। বছর বছর সাড়া ফেলে দেওয়ার মতো সব নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় দেশটিতে। হতাশ হতে হয়নি ২০২১ সালে এসেও। এ বছরে দেশটির মরুভূমির বুক চিরে খুঁজে বের করা হয়েছে আস্ত একটি প্রাচীন নগর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরটি তিন হাজার বছরের পুরোনো। মিসরে এখন পর্যন্ত সন্ধান মেলা সবচেয়ে বড় প্রাচীন নগর এটি।
২০২০ সালে মিসরের লুক্সর শহরে প্রথম হারানো এ নগরের সন্ধান মেলে। এর পর থেকেই সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। গত এপ্রিল পর্যন্ত নগরীটির দক্ষিণাংশের বেশির ভাগ দৃশ্যমান হয়েছে।
শহরটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেতসি ব্রায়ান বলেন, হারিয়ে যাওয়া এ নগরীর সন্ধান তুতেনখামেনের সমাধির পর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। নগরীটির ঘরগুলোতে থাকা জিনিসপত্র এমনভাবে রয়েছে, যেন মনে হচ্ছে গতকালও সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল।
প্রাণীর প্রাচীনতম গুহাচিত্র
দীর্ঘদিন ধরে মনে করা হতো, সবচেয়ে প্রাচীন গুহাচিত্রগুলো শুধু ইউরোপেই পাওয়া যায়। সে ভুল ভেঙেছে আগেই। ইন্দোনেশিয়ার গুহাগুলোতেও প্রাচীন মানুষের আঁকা সব চিত্রকর্মের সন্ধান মিলেছে। সেগুলো আঁকার সাল–তারিখ শুনলে চোখ কপালে উঠবেই।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে গুহার দেয়ালে পাওয়া গেছে ৪৫ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো চিত্রকর্ম। ধারণা করা হচ্ছে, এটিই এখন পর্যন্ত টিকে থাকা সবচেয়ে পুরোনো প্রাণীর গুহাচিত্র। গুহাচিত্রে শূকরসদৃশ তিনটি প্রাণীকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকার অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এর আগেও একই অঞ্চলে আরও কিছু গুহাচিত্রের খোঁজ পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ৪৩ হাজার ৯০০ বছরের পুরোনো।
বলিদানের গর্তে সোনার মুখোশ
এক শ বছর আগের কথা। চীনের চেংদু শহরের কাছে হুট করেই একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের সন্ধান পান স্থানীয় এক কৃষক। এরপর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে হাজার হাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। গত জুনে স্যানজিংদুই নামের ওই স্থানে বলিদানের কয়েকটি গর্ত থেকে ৫০০টির মতো নিদর্শন খুঁড়ে বের করা হয়। সেগুলোর মধ্যে একটি সোনার তৈরি ভাঙা মুখোশ ছিল। সেটি সাং রাজবংশের আমলের। খ্রিষ্টপূর্ব ১০৪৬ সাল পর্যন্ত চীনে শাসন করেছিল এই রাজবংশ।
সাড়া ফেলা ছোট্ট পুঁতি
যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের পূর্বাঞ্চলে বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ছোট ছোট কিছু পুঁতি মাটি খুঁড়ে বের করা হয়। পুঁতিগুলো ইউরোপে তৈরি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সেগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রথম পৌঁছানো ইউরোপে তৈরি সামগ্রীর একটি। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগেই নাকি সেগুলো ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকায় নেওয়া হয়।
গত জানুয়ারিতে একটি গবেষণা প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকস। গবেষণায় উঠে আসে, ওই পুঁতিগুলো ১৪৪০ থেকে ১৪৮০ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় নেওয়া হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর ১৪৯২ সালে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন কলম্বাস।
ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাংকস বলছে, ১৪ শতকে ইতালির ভেনিস ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। সে সময়েই হয়তো ইউরোপ থেকে সিল্করোড ধরে চীনে পৌঁছায় পুঁতিগুলো। সেখান থেকে যায় রাশিয়ার একেবারে পূর্বাঞ্চলে। এরপর বেরিং প্রণালি পেরিয়ে আর্কটিক হয়ে উত্তর আমেরিকার পথ খুঁজে নেয়।
শেষ নয় এখানেই
চলতি বছরের মার্চে ‘ডেড সি স্ক্রলের’ বেশ কিছু খণ্ডাংশের খোঁজ পাওয়ার খবর জানায় ইসরায়েল সরকার। খণ্ডাংশগুলোতে পবিত্র বাইবেলের বাণী পাওয়া গেছে। ইসরায়েলের জবরদখল করা পশ্চিম তীরের জুডিয়ান মরুভূমি থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সেগুলো খুঁজে পান। প্রাচীন ইহুদি ধর্ম ও হিব্রু ভাষাভাষী সংশ্লিষ্ট পাণ্ডুলিপি ডেড সি স্ক্রল নামে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে মৃত সাগরের উত্তর উপকূলে এ পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়।
গত মার্চেই ৩ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো ম্যুরাল খুঁজে পাওয়ার কথা সামনে আনেন গবেষকেরা। ম্যুরালটিতে ছুরি হাতে এক ‘মাকড়সা দেবতা’র ছবি রয়েছে। ২০২০ সালে পেরুর উত্তরাঞ্চল থেকে সেটি উদ্ধার করা হয়।
পরে মে মাসে এসে প্রাচীন রোমের প্রথম সম্রাট অগাস্টাস অক্টাভিয়ানের মাথার প্রতিকৃতির খোঁজ মেলে। মার্বেল পাথরের তৈরি প্রতিকৃতিটি ২ হাজার বছরের পুরোনো। ইতালির আইসেরনিয়া শহরে একটি মধ্যযুগীয় প্রাচীর সংস্কারের সময় এর সন্ধান পাওয়া যায়।
আগস্টে আরেক চমকপ্রদ খবর সামনে আসে। ফিনল্যান্ডে প্রস্তর যুগের একটি কবর থেকে একজন যোদ্ধার দেহাবশেষ উদ্ধার করা হয়। ডিএনএ বিশ্লেষণ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ওই যোদ্ধা তৃতীয় লিঙ্গের ছিলেন।
আর গত নভেম্বরে মিসরে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চবিংশ শতকের একটি মন্দির খুঁজে পান প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। সেটি মিসরের হারিয়ে যাওয়া ‘সূর্য মন্দির’ বলে মনে করছেন তাঁরা।
ভাষান্তর: শেখ নিয়ামত উল্লাহ