ঐ মহামানব আসে

স্বাগত নৌকা, বিদায় নৌকা

যতটা আমি আশা করেছিলাম, তার চেয়ে তোমাকে ভালো দেখাচ্ছিল। তবে ডিসেম্বর ১৯৬৮-তে আমাদের বিগত সাক্ষাতের সময় যতটা মনে হয়েছিল, ততটা নয়। ক্রমবর্ধমান অজস্র চাপের সামগ্রিক ছাপ তোমার ওপর খুব স্পষ্ট ছিল। সাক্ষাত্ শেষে আমি যখন ফিরে যাচ্ছি, এমন একটা ভয় আমাকে কাবু করে ফেলল যে, রাতের পরবর্তী বারোটি ঘণ্টা তোমাকে একাকিত্ব আর উদ্বেগে মধ্যেই কাটাতে হবে। আর তা তোমার অবস্থা আরও খারাপ করে দিতে পারে। সেই ভয়টা এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।

দর্শনার্থী কক্ষের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় ঘটনাক্রমেই আমি সেই নৌকাটি দেখতে পেয়েছিলাম, যেটিতে করে তুমি আসছিলে। উজ্জ্বল রঙের সুন্দর নৌকাটি বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে বন্দরের দিকে ভেসে আসছিল। দূর থেকেও সেই নৌকাটিকে কারাবন্দীর প্রকৃত বন্ধুর মতোই দেখাচ্ছিল। সেটি যতই এগিয়ে আসছিল, ততই আমার উদ্বেগ বেড়ে যাচ্ছিল। কেন এমন হচ্ছিল, সেটা তুমি জানো!

আমি আবার এও দেখছিলাম যে, নৌকাটি মূল ভূখণ্ডের দিকে ফিরে যাচ্ছে। এই দৃশ্যটি ছিল একেবারে ভিন্ন। যদিও নৌকাটি তখনো বেশ উজ্জ্বল, তবু মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে দেখা তার সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। সেটাকে দেখাচ্ছিল কিম্ভূতকিমাকার, আর একেবারেই অবন্ধুসুলভ। নৌকাটি যতই তোমাকে নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছিল, আমি ততই একাকী হয়ে যাচ্ছিলাম। যেসব বইপত্রে আমার কারাকক্ষ ঠাসা, যেগুলো এত বছরজুড়ে আমাকে সঙ্গ দিয়েছে, সেগুলোও যেন বোবা আর নিরুত্তর হয়ে গিয়েছিল। আমি কি আমার প্রিয়তমাকে শেষবারের মতো দেখলাম—এ প্রশ্নটাই মনের ভেতরে ঘুরেফিরে আসছিল।

উইনি ম্যান্ডেলাকে ১৬ নভেম্বর ১৯৭০-এ লেখা চিঠি

রাষ্ট্র পরিচালনায় নারী

১৯৭৯ সালকে তুমি ঠিকই নারীবর্ষ বলতে পারো। স্পষ্টতই তারা চাইছে যে, নারী-পুরুষ সমতাবিষয়ক হিতোপদেশের ভিত্তিতে সমাজ পরিচালিত হোক। ফরাসি নারী সিমোঁ ভেইল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়ে ভয়ানক সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন, অন্যদিকে পর্তুগালে মারিয়া পিন্তাসিলগো চাবুকটাই ভেঙে দিয়েছিলেন। কার্টার-পরিবারটিকে কে পরিচালনা করছে, কোনো প্রতিবেদন থেকেই তা স্পষ্ট করে জানা যায় না। একসময় কার্টার-পরিবারের রোজালিন৩৩ ট্রাউজার পরতেন। মার্গারেট থেচারের কথা তো উল্লেখ না করলেও চলে। বিশ্বজোড়া বিপুল সাম্রাজ্যের পতন ও তৃতীয় মহাযুদ্ধের পরে তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেন এখনো অনেক দিক থেকেই বিশ্বের কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। সেখানে যা কিছুই ঘটে, দূর-দূরান্তেও তার প্রভাব পড়ে।

ইন্দিরা (গান্ধী) আমাদের ঠিকভাবেই স্মরণ করিয়ে দেবেন যে, এ ক্ষেত্রে ইউরোপ কেবল এশিয়ার পদাঙ্কই অনুসরণ করছে। গত দুই দশকে এশিয়াতে দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এ কথাও ঠিক যে...গত কয়েক শতাব্দীতে অনেক নারীই শাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। স্পেনের ইসাবেলা, ইংল্যান্ডের প্রথম এলিজাবেথ, রাশিয়ার ক্যাথারিন দ্য গ্রেট (যদিও আমার জানা নেই, তিনি কেমন ‘গ্রেট’ ছিলেন), বাটলকোয়ার রানি মান্তাতিসিসহ৩৪ আরও অনেকেই। কিন্তু তাঁরা সবাই বংশানুক্রমিক প্রভাবে নারী হিসেবে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ লাভ করেছিলেন। আজকের যুগে পাদপ্রদীপের আলো কেবল তাঁদের ওপরই পড়বে, যাঁরা আপন যোগ্যয় উচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছেন।

উইনি ম্যান্ডেলাকে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯-এ লেখা চিঠি

অন্য গ্রাসা

গ্রাসা ম্যাশেলের৩৫ সঙ্গে জোহানেসবার্গে অনন্ত তিনবার আমার দেখা হয়েছে। তিনি সময় বিনয়ী, বিচক্ষণ ও সহমর্মী ছিলেন। কিন্তু মাপুতোতে—যেখানে তিনি ১৪ বছর শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন এবং এখনো সংসদ সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন—একেবারে আলাদা এক গ্রাসার সাক্ষাত্ পেয়েছিলাম। যেখানে তাঁকে মনে হতো দৃঢ় ও কর্তৃত্বশীল, একই সঙ্গে সৌজন্যপরায়ণ ও মধুর।

প্রেসিডেন্ট শিসানোর৩৬ জন্য আমি আমার হূদয়ে গভীর শ্রদ্ধা লালন করি।

ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে

নেতার দুই ধরন

নেতা দেখা যায়  দুই রকমের:

১. তাঁরা অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন, তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে পূর্বধারণা করা যায় না। তাঁরা একটি বিষয়ে আজ সম্মতি জানিয়ে কালই অসম্মতি প্রকাশ করতে পারেন।

২. তাঁরা সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং তাঁরা স্বপ্নদ্রষ্টাও।

ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে

ভবিষ্যতের স্বপ্ন

ভবিষ্যতের স্বপ্ন নির্মাণ করাই নেতার প্রথম কাজ।

দ্বিতীয় কাজটি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহায়ক কর্মীদল গঠন করা, যারা কার্যকরভাবে নেতার নির্দেশমতো ব্যবস্থা নেবে। নেতাকে অনুসরণকারী কর্মীদের ভবিষ্যতের লক্ষ্য সম্পর্কেও জানতে হবে। কারণ, নেতা সেই স্বপ্ন বা লক্ষ্যকে অনুসরণকারীদের প্রাণে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন এবং লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটিও ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

ম্যান্ডেলার নোটবই থেকে

১. অধ্যাপক ফাতিমা মির (১৯২৮-২০১০): লেখক, শিক্ষাবিদ, বর্ণবাদবিরোধী সক্রিয় সংগ্রামী। দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত নাটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অশ্বেতাঙ্গ শিক্ষক। নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনীগ্রন্থ হায়ার দ্যান হোপ-এর রচয়িতা।

২. ম্যান্ডেলা ছিলেন থেম্বু গোষ্ঠীর রাজপরিবারের সন্তান। গোষ্ঠীপতির পছন্দানুসারে বিয়ে করাই ছিল ম্যান্ডেলার জন্য স্বাভাবিক।

৩. রিচার্ড স্টেঙ্গেল: সম্পাদক, লেখক। ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এর রচনার সহায়তাকারী। ম্যান্ডেলা তথ্যচিত্রের সহযোগী প্রযোজক। টাইম ম্যাগাজিনের সম্পাদক।

৪. ঝোসা ও সোথো: দক্ষিণ আফ্রিকায় সরকারিভাবে স্বীকৃত ১১টি ভাষার অন্তর্গত দুটি ভাষা।

৫. ঝোসা সম্প্রদায়ের প্রথাগত সংস্কার অনুসারে খতনার মাধ্যমে বালকের উত্তরণ ঘটে পুরুষে। ম্যান্ডেলার করা হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে।

৬. ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রথম কলেজ।

৭. তাঁর প্রকৃত নাম ছিল জোহানেস (স্কিপার এডোনিস) মোলোিস।

৮. উইনি ম্যান্ডেলা ছিলেন বারাগবানাথ হাসাপাতালের কর্মী।

৯. মাইকেল হারমেল (১৯১৫-৭৫): সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী, বর্ণবাদবিরোধী নেতা। আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য।

১০. জো স্লোভো (১৯২৬-৯৫): বর্ণবাদবিরোধী নেতা, আফ্রিকান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য, উইটওয়াটারস্ট্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্রিয় ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মী।

১১. গাউর রেদেবে (১৯০৮-১৯৬৮): রাজনৈতিক ও বর্ণবাদবিরোধী সক্রিয়তাবাদী।

১২. রাস্টি বার্নস্টাইন (১৯২০-২০০২): স্থপতি, বর্ণবাদবিরোধী সক্রিয়তাবাদী, দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য। ‘কংগ্রেস অব ডেমোক্রেটস’ নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নেতা।

১৩. ম্যান্ডেলা দুটি নামই ব্যবহার করতেন: ঔপনিবেশিক নাম ‘উমতাতা’ এবং উপনিবেশপূর্ব নাম ‘ম্থাথা’।

১৪. বান্টু কর্তৃপক্ষ আইন, ১৯৫১ অনুসারে বর্ণবাদী সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য ‘বান্টুস্তান’ নামে ‘হোমল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

১৫. অ্যালবার্ট লুথুলি (১৮৯৮-১৯৬৭): অ্যালবার্ট জন ম্ভুম্বি লুথুলি ছিলেন শিক্ষক, বর্ণবাদবিরোধী নেতা, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী। অহিংস পন্থায় বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে কারণে ১৯৬০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

১৬. সিসিল উইলিয়ামস (মৃত্যু ১৯৭৯): থিয়েটারের পরিচালক, বর্ণবাদবিরোধী শ্বেতাঙ্গ নেতা।

১৭. এমকে: দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় আন্দোলনের একপর্যায়ে নেলসন ম্যান্ডেলা এমকে বা উমখন্তো উই সিজওয়ে নামের সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর অর্থ ‘আক্রমণের সম্মুখভাগে থাকার জন্য প্রস্তুত দল’।

১৮. ম্যান্ডেলার বক্তব্য, ‘নিষ্ক্রিয় বাধাদানের প্রচেষ্টার সময় ফুরিয়ে গেছে।’

১৯. মোজেস কোটানে (১৯০৫-৭৮): রাজনৈতিক ও বর্ণবাদবিরোধী নেতা। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল। এএনসির মহাকোষাধ্যক্ষ।

২০. মাসাবালালা বনি (এমবি) ইয়েংগোয়া: বর্ণবাদবিরোধী নেতা ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী।

২১. ডা. গঙ্গাথুরা মোহাম্ব্রি (মন্টি) নাইকার (১৯১০-৭৮): চিকিত্সক, রাজনীতিবিদ, বর্ণবাদবিরোধী নেতা।

২২. ডেনিস হিলি (১৯১৭): ব্রিটিশ শ্রমিকদলীয় রাজনীতিবিদ।

২৩. হিউ গেইটস্কেল (১৯০৬-৬৩): ব্রিটিশ শ্রমিকদলীয় রাজনীতিবিদ।

২৪. হ্যারল্ড ম্যাকমিলান (১৮৯৪-১৯৮৬): ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৭-৬৩)।

২৫. অ্যান্থনি স্যাম্পসন (১৯২৬-২০০৪): লেখক, সাংবাদিক। ম্যান্ডেলার জীবনীগ্রন্থ ম্যান্ডেলা: দ্য অথরাইজড বায়োগ্রাফির রচয়িতা।

২৬. এখানে ম্যান্ডেলা প্রিটোরিয়ার স্থানীয় কারাগারে বিচারাধীন কয়েদি হিসেবে নিঃসঙ্গ বন্দিত্বের কথা বলছেন।

২৭. ভিক্টর ভারস্টার: স্বল্প নিরাপত্তার একটি কারাগার। ১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছিল।

২৮. কাগঙ্গো (১৯৫০-২০০৫): মাকগাথো (ক্গাথো) ম্যান্ডেলার প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত দ্বিতীয় সন্তান। আইনজীবী। এইডস জটিলতায় ২০০৫ সালে মৃত্যু হয়েছিল।

২৯. মাদিবা: নেলসন ম্যান্ডেলার গোত্রনাম।

৩০. কে ডি মাতাঞ্জিমা (১৯১৫-২০০৩): থেম্বু গোষ্ঠীর প্রধান, রাজনীতিবিদ। নেলসন ম্যান্ডেলার ভ্রাতুষ্পুত্র। ১৯৬৩ সালে ট্রানস্কি-বান্টুস্তান নামেমাত্র স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী।

৩১. ১৯৬৯ সালে উইনি ম্যান্ডেলাকে ১৭ মাস নিঃসঙ্গ কারাগারে আটক করে রাখা হয়।

৩২. কোটাভিত্তিক নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত যেসব চিঠি লেখার সুযোগ বন্দীরা পেতেন, তাকে ‘বিশেষ’ বলে বিবেচনা করা হতো। সাধারণত বন্দীর পরিবারের কারও মৃত্যু বা পড়াশোনার প্রয়োজনে ‘বিশেষ পত্র’ পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হতো।

৩৩. রোজালিন কার্টার (১৯২৭): প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের পত্নী।

৩৪. মান্তাতিসি (১৭৮০-১৮২৬): বােভাকোয়াস (সোথো)-র গোষ্ঠীপতি (১৮১৩-২৬)।

৩৫. গ্রাসা ম্যাশেল (১৯৪৫): মোজাম্বিকের অধিবাসী শিক্ষক, সক্রিয় মানবাধিকারবাদী, নারী ও শিশু অধিকারবিষয়ক                 আন্তর্জাতিক আইনবিদ। মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট সামোরা ম্যাশেলের বিধবা। ম্যান্ডেলার তৃতীয় পত্নী।

৩৬. প্রেসিডেন্ট শিসানো: জোয়াকিম অ্যালবার্টো শিসানো ছিলেন মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট (১৯৮৬-২০০৫)।