ঐ মহামানব আসে

ছবি ছবি নয়

শেষ পর্যন্ত একটি পারিবারিক ছবি!—‘কী চমত্কার শিল্পকর্ম’! কাগঙ্গো,২৮ বোনদের ও মায়ের ছবি দেখে দারুণ আনন্দ পেয়েছি। তোমার ছোট্ট ছবিটি প্রায়-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেওয়ার মতো। ‘আইঙ্গু নবান্দলালু!’ ‘ওটা কি তাঁর ছোট বোন নাকি!’ ‘মাদিবা২৯ অনেক বছর ধরে কারাগারে বলে তার শ্যালিকাকেও চিনতে পারছে না’—এসব মন্তব্য চারপাশ থেকে আমার দিকে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল।

ছবিটি আমার ভেতরে মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার করেছে। তোমাকে কিছুটা বিষণ্ন ও অসুস্থ দেখাচ্ছে, কিন্তু সুন্দর ও একই রকম। বড় ছবিটি চমত্কার। এখানে তুমি সব মিলিয়েই সে রকম, আমি তোমাকে যেমনটি জানি, সেই সর্বনাশা সৌন্দর্য। কী অপূর্ব! ১০টি বিবাহিত বছরের ঝড়ঝাপটায় যা এতটুকু শীতল হয়ে যায়নি। আমার তো মনে হয়, তুমি ছবিটাতে এমন একটা বার্তা পাঠাতে চেয়েছ, কোনো কথা দিয়ে যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তুমি নিশ্চিত থাকো, সে বার্তাটি আমি পেয়ে গেছি। এখন আমার বলার কথা হচ্ছে, ছবিটি আমার ভেতরে সব রকমের নমনীয় অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছে, আর চারদিকের বিষাদের ভারটাও যেন হালকা হয়ে গেছে। ছবিটি তোমার প্রতি, আমাদের মধুর ও শান্তিময় সংসারের প্রতি আমার আকর্ষণকে তীব্রতর করে তুলেছে।

এখন আমার ভাবনাগুলো দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো বা হ্যানস্ স্ট্রিটে, যেখানে আমার এক বন্ধু একটা নীল ভ্যানগাড়ির ওপর লাফিয়ে পড়ে নিজেকে তাঁর সব পবিত্র প্রতিজ্ঞার বন্ধন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল, যে প্রতিজ্ঞাগুলো তাঁর পুরুষ বন্ধুর দ্বারা সঞ্চারিত হয়েছিল, সে যার বাগ্দত্তা ছিল, আর এর পরপরই একই ব্লকের বিপরীত প্রান্তে সমান মধুর প্রতিজ্ঞা, সমান আশ্বাস নিয়েই মুখোমুখি ঝাঁপ দিয়েছিল একটি ওল্ড’স মোবাইলের সামনে। কী দারুণ দক্ষতায় তিনি তাঁর বৈকালিক পাঠের সময়টাকে চ্যান্সেলর হাউসে নিয়োজিত করেছিলেন পুরোনো বন্ধুবান্ধবের আপ্যায়নের কাজে—নতুন বন্ধুরা বক্সিং জিমে যাওয়ার জন্য উঠে গেলেই যেখানে পুরোনোরা এসে হাজির হতেন।

যতই ছবিটা দেখছি, ততই বারবার ঘুরেফিরে এসব কথা মনে পড়ছে।

উইনি ম্যান্ডেলাকে ২ এপ্রিল ১৯৬৯-এ লেখা চিঠি

মায়ের মৃত্যু

আমি মাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর। সাক্ষাতের পরে তিনি যখন মূল ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে যাচ্ছেন, পেছন থেকে তাকিয়ে তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, মাকে বোধ আর চোখে দেখতে পাব না। তাঁর সাক্ষাত্ আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করত। তাঁর মৃত্যুসংবাদে আঘাতও পেয়েছি নিদারুণ। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আমার নিঃসঙ্গ ও শূন্য মনে হলো। তবে এখানে আমার যে বন্ধুরা রয়েছে, যাঁদের সহানুভূতি ও স্নেহ সারাক্ষণ আমাকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে, তাঁরা আমাকে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে এবং মনোবল জোগাতে সহায়তা করেছেন।

শেষকৃত্যের প্রতিবেদনটি আমার মনোবল বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের মর্যাদা বাড়াতে আমাদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়েছেন জেনে আনন্দ পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে আপনিও উপস্থিত ছিলেন জেনে বিশেষ ভালো লেগেছে।

কে ডি মাতাঞ্জিমাকে৩০ ১৪ অক্টোবর ১৯৬৮-তে লেখা চিঠি

দুই মেয়েকে

আমাদের প্রিয়তম মাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।৩১ মা আর বাবা দুজনই এখন কারারুদ্ধ। এ কথা ভাবলে আমার হূদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যে, সে এখন বাড়ি থেকে অনেক দূরের কোনো পুলিশ সেলে বসে আছে, সম্ভবত নিঃসঙ্গ এবং কথা বলার মতো কেউ সেখানে নেই, হয়তো পড়বার মতোও কিছুই নেই। দিনের ২৪ ঘণ্টাই তিনি তাঁর ছোট ছোট সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় কাটাচ্ছেন। হয়তো অনেকগুলো মাস বা অনেক বছর পর তোমরা আবার তাকে দেখতে পাবে। তত দিন তোমাদের এতিমের মতোই নিজের বাড়িঘর ও বাবা-মা ছাড়া কাটাতে হবে।

তোমাদের মা যেমনটা দিতে পারতেন, তেমন প্রকৃত ভালোবাসা, স্নেহ ও নিরাপত্তা পাবে না। তোমাদের জন্য এখন আর কোনো জন্মদিন বা বড়দিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে না। কোনো উপহার নয়, নতুন পোশাক নয়, জুতা বা খেলনাও নয়। সেসব দিন চলে গেছে, যখন তোমরা বিকেলে উষ্ণ স্নান সেরে মায়ের সঙ্গে টেবিলে বসে তাঁর রান্না করা সরস ও সাধারণ খাবারগুলো উপভোগ করতে। আরামদায়ক বিছানাগুলোও থাকবে না—উষ্ণ কম্বল আর পরিচ্ছন্ন চাদর বিছিয়ে তিনি তোমাদের জন্য যেমনটি করে দিতেন। এখন আর মা তোমাদের বন্ধুবান্ধব ডেকে সিনেমায় বা গানের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে পারবেন না। বিকেলে সুন্দর সুন্দর গল্পও বলতে পারবেন না। কঠিন বই পড়তে তোমাদের সাহায্য করা বা তোমাদের পছন্দমতো অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও সম্ভব হবে না। তোমরা যখন বড় হয়ে উঠছ, যখন নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে, তখন তিনি আর তোমাদের সাহায্য করতে বা সঠিক পথ দেখাতে পারবেন না। হয়তো পশ্চিম ওরল্যান্ডোর ৮১১৫ নম্বর বাড়িটিতে—যা আমাদের সবার হূদয়ে একান্ত প্রিয়—সেখানে মা-বাবা আর কখনো তোমাদের সঙ্গে একত্র হতে পারবেন না।

মায়ের জেলে যাওয়া তো এবারই প্রথম নয়। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে, আমাদের বিবাহের মাত্র চার মাস পরই আরও ২০০০ মহিলার সঙ্গে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁরা তখন জোহানেসবার্গ শহরে ‘পাস’ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সেবার তাঁকে দুই সপ্তাহ জেলে থাকতে হয়েছিল। গত বছরও তিনি চার দিন আটক ছিলেন। এবার আবার জেলে যেতে হলো। আমি তোমাদের বলতে পারব না, কত দিন তাঁকে বাড়ির বাইরে আটক থাকতে হবে। আমি আশা করি, তোমরা সব সময় এ কথাটি মনে রাখবে যে, তোমাদের মা একজন সাহসী ও সংকল্পবদ্ধ মানুষ। তিনি সমগ্র হূদয় দিয়ে মানুষকে ভালোবাসেন। দেশ ও জনগণের জন্য গভীর ভালোবাসার কারণেই তিনি সুখ ও আরামের জীবনের বদলে একান্ত কষ্টসাধ্য দুঃখের জীবন বরণ করে নিয়েছেন।

তোমরা যখন বড় হয়ে উঠবে, তখন গভীরভাবে ভেবে দেখো, কী নিদারুণ দুর্ভোগের মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হচ্ছে। আর কতটা দৃঢ়ভাবে তিনি তাঁর বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামে তাঁর অবদানের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তখনই তোমরা বুঝতে পারবে। তিনি নিজের স্বার্থ বা সুখের চিন্তা না করে কী বিপুল ত্যাগ স্বীকার করছেন, সেটিও তোমরা তখন উপলব্ধি করতে পারবে।...

এত দিন পর্যন্ত তোমাদের মা একটা বেদনাভরা জীবন কাটিয়েছেন। তিনি সব সময় নিয়মিত আয়-উপার্জনহীন একটি পরিবারকে টেনে বেড়িয়েছেন। তবু তিনি কোনো না কোনো উপায়ে তোমাদের জন্য খাদ্য ও পোশাক কিনেছেন, তোমাদের স্কুলের বেতন দিয়েছেন, বাড়িভাড়া মিটিয়েছেন আর আমাকেও নিয়মিত টাকাপয়সা পাঠিয়েছেন।

আমি ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। জেনির বয়স তখন দুই বছর আর জিন্দজি মাত্র তিন মাসের। ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমি আফ্রিকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ১০ দিনের জন্য লন্ডনেও গিয়েছিলাম। সে বছরই জুলাই মাসে আমি দেশে ফিরে আসি। তোমাদের মায়ের সঙ্গে দেখা হতেই আমি ভীষণ আঁতকে উঠেছিলাম। যখন বাড়ি ছেড়ে যাই, তখন তাঁর স্বাস্থ্য ভালো ছিল—শরীর পুষ্ট, বর্ণে উজ্জ্বলতা। কিন্তু হঠাত্ই তাঁর ওজন কমে গেছে, আসলে আগের তুলনায় তিনি তাঁর নিজেরই ছায়া মাত্র। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার অনুপস্থিতি তাঁকে কী দুঃসহ ক্লান্তিকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। আমি কোন কোন দেশ ভ্রমণ করেছি, কাদের সঙ্গে সাক্ষাত্ হয়েছে—এসব কথা বলতে শুরু করার আগে আমাকে বেশ কিছুটা সময় নিতে হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট আবার আমাকে গ্রেপ্তার করায় সে স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৮ সালে মা যখন গ্রেপ্তার হলেন, তখন আমি প্রতিদিনই খাবার ও ফল ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম।

আমি যখন বন্দী, তখন এক সাক্ষাতের সময় তোমাদের মা বলেছিলেন, যদিও তাঁর ধারণা, যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে—যেমনটি স্বাধীনতার সংগ্রামে রত সব রাজনীতিবিদই ভাবেন—তবু তিনি দেশে থেকেই তাঁর জনগণের সব দুর্ভোগের অংশভাগী হবেন। এখন কি উপলব্ধি করতে পারছ, কেমন বিপুল সাহসী মা তোমাদের?

যথাক্রমে ৯ ও ১০ বছর বয়সী দুই মেয়ে জেনি ও জিন্দজি ম্যান্ডেলাকে লেখা চিঠি

ছেলের মৃত্যুর অনুভব

আজই বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে কমান্ডিং অফিসার নিচের টেলিগ্রামটি পেয়েছেন:

অনুগ্রহপূর্বক নেলসন ম্যান্ডেলাকে অবহিত করবেন যে, তাঁর (পুত্র) থেম্বেকিল চলতি মাসের ১৩ তারিখে কেপটাউনে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কষ্টকর ছিল যে, আমি আর থেম্বিকে দেখতে পাব না। এ বছরই ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখে ওর বয়স হয়েছিল ২৪ বছর। ১৯৬২ সালে আমার বিদেশ থেকে ফেরার কয়েক দিন পরেই জুলাই মাসের শেষ দিকে আমি তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম। তখন সে ছিল ১৭ বছরের এক নাদুসনুদুস কিশোর। তার সঙ্গে আমি কিছুতেই মৃত্যুকে মেলাতে পারছি না। সে আমার একটি ট্রাউজার পরেছিল, যেটা ছিল ওর জন্য এক দাগ বড় ছিল, এমনকি লম্বাও। ইঙ্গিতবহ সেই ঘটনাটি নিয়ে আমি ভেবেছি। তুমি তো জানো, ওর অনেক পোশাক ছিল, আর পোশাক নিয়ে ওর অনেক বাছবিচারও ছিল। তাই আমার পোশাক পরার কোনো প্রয়োজনই ওর ছিল না। ওর সে আচরণের আবেগের দিকটা ছিল খুবই স্পষ্ট। সেটি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। পরের বেশ কয়েকটি দিন আমি মনেপ্রাণে তীব্রভাবে আলোড়িত হয়ে ভেবেছি, বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি আমার সন্তানদের ওপর কী গভীর চাপ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। আমার মনে পড়েছিল, ১৯৫৬ সালে জোহানেসবার্গ দুর্গে বিচারাধীন বন্দী থাকার সময়ের কথা। তখন কাগঙ্গোর বয়স মাত্র ছয়। সে পূর্ব ওরল্যান্ডোতে থাকত। সে জানত আমি বন্দী অবস্থায় রয়েছি, তবু সে পশ্চিম ওরল্যান্ডোতে গিয়ে মায়ের কাছে বলেছিল, সে আমাকে দেখতে চায়। ওই রাতে সে আমার বিছানায় ঘুমিয়েছিল।

এবার থেম্বির সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথায় আসছি। বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার পথে সে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। এখানে এসে সে আমাকে খুবই উষ্ণ অভিবাদন জানায়, কিছুক্ষণ আমার হাত ধরে রাখে। তারপর বসে কথা বলতে শুরু করে। আলোচনাক্রমে তার পড়াশোনার কথা উঠতেই সে আমাকে, তার তখনকার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয়ভাবে শেকসিপয়ারের জুলিয়াস সিজার-এর কথা বলছিল। সেটি আমি বিশেষভাবে উপভোগ করেছিলাম।

সে মাতাতিয়েলে স্কুলে যাওয়ার পরে এবং সেখান থেকে ঔডহাউসে স্থানান্তরের পরও আমাদের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল।

১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে আমি গাড়িতে করে কিছু দূরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনো আমি তাকে শিশুই মনে করতাম, আর সেভাবেই কথা বলতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৯৬২ সালে কথা বলার সময় বুঝেছিলাম, আমি আর ছোট্ট কারও সঙ্গে কথা বলছি না। বরং তাকে এমন একজন বলে মনে হয়েছিল, যে নিজের জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে ফেলেছে। সে যেন হঠাত্ করেই পুত্র থেকে মিত্রের অবস্থানে উঠে এসেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, বিদায় নেওয়ার সময় আমি কিছুটা বিষণ্নই হয়ে পড়েছিলাম। আমি তাকে কোনো বাসস্টপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে বা স্টেশনে বিদায় জানাতেও যেতে পারিনি। কারণ, আমার মতো কোনো সরকার-ঘোষিত অপরাধীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পিতৃসুলভ কর্তব্য পালন করাও ছিল নিষিদ্ধ। সুতরাং, আমার পুত্র, না, আমার বন্ধুটি এ জগতে নিজের দায়িত্ব নিয়ে একাই বেরিয়ে গেল। আমি তো শুধু গোপনেই অনেক দিন পর পর তার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম। আমি জানতাম, তুমি তাকে কাপড়চোপড় কিনে দিয়েছ। কিছু নগদ টাকাও দিয়েছ। একজন পলাতক হতভাগার পক্ষে যা সম্ভব, আমিও পকেট উজাড় করে তাম্রমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রা মিলিয়ে যা কিছু ছিল, সবই তাকে দিয়ে দিলাম।

রিভোনিয়া মামলা চলার সময় একদিন সে আমার পেছনে বসে ছিল। আমি পেছন ফিরে মাথা ঝুঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বেশ বড় করে হেসেছিলাম। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, আর কখনো ওর দেখা পাব না। সে তো পাঁচ বছর আগের কথা...এখন যেমন মনে হচ্ছে, আগে তোমাকে কখনো এমন করে চাইনি। আজকের এ দুর্ভাগ্যের মধ্যে এসব বিপরীত কথা মনে ভাবতেই ভালো লাগছে। লেখক পি জে শোম্যান একজন আফ্রিকি সেনাধ্যক্ষের গল্প লিখেছেন, যিনি তাঁর চৌকস কালো যোদ্ধাদের নিয়ে শিকারে গিয়েছিলেন। শিকারের পেছনে ছোটার সময় একটি সিংহী তাঁর পুত্রকে মেরে ফেলেছিল। সেনাধ্যক্ষ নিজেও পশুটির দ্বারা দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষতস্থানটিকে জীবাণুমক্ত করার জন্য একটি লোহার ফলা লাল-গরম করে ছ্যাঁকা দেওয়ার সময় আহত মান্যবরকে সেই কষ্টদায়ক চিকিত্সাও সইতে হয়েছিল। পরে একসময় শোম্যান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেমন লেগেছিল? সেনাধ্যক্ষ জবাব দিয়েছিলেন, দৃশ্যমান ব্যথার চেয়ে অদৃশ্য ব্যথাই ছিল অনেক বেশি। এখন আমি জানি, সেনাধ্যক্ষ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।

ছেলে থেম্বির মৃত্যুসংবাদ পেয়ে উইনি ম্যান্ডেলাকে ১৬ জুলাই ১৯৬৯-এ লেখা বিশেষ৩২ চিঠি