কেন হারায় শৈশবের স্মৃতি?

.
.

শিশুদের মস্তিষ্ক সজীব, তাই অজস্র তথ্য সংরক্ষণের উপযোগী। তবু বড় হওয়ার পর আমরা শৈশবের অনেক স্মৃতিই হারিয়ে ফেলি কেন? মনোবিজ্ঞানী, স্নায়ু বা মস্তিষ্ক বিশেষজ্ঞ ও ভাষাবিজ্ঞানের গবেষকেরা বহুদিন ধরে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন।
জন্মের পরের মুহূর্তগুলো, প্রথম মাটিতে পা ফেলা, প্রথম কথা শেখা বা প্রথম শক্ত খাবার গ্রহণের স্মৃতিগুলো মনে রাখতে পারলে তা সবার কাছেই হতো অমূল্য। কিন্তু জীবনের প্রথম কয়েকটি বছরের এই সব সময়ের কথা আমরা মনে করতে চাইলেও পারি না। ব্যাপারটা নিয়ে অন্তত ১০০ বছর আগেই ভেবেছিলেন মনোসমীক্ষার জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। তিনি এ সমস্যার নাম দেন ‘ইনফ্যান্ট অ্যামনেশিয়া’ বা শিশুর স্মৃতিলোপ।
বিজ্ঞান বলছে, শিশু-মস্তিষ্কের সামর্থ্য বা ক্ষমতা বিস্ময়কর। এটা প্রতি সেকেণ্ডে ৭০০ নতুন স্নায়ু-সংযোগ গড়ে তোলে। ফলে শিশুরা একসঙ্গে একাধিক ভাষা দ্রুত শিখতে পারে। সাম্প্রতিক গবেষণায় ইঙ্গিত মিলেছে, মাতৃগর্ভে থাকার সময়ই শিশুর মস্তিষ্কের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়।
সারা জীবনের অনেক ঘটনা যেমন মনে থাকে, তেমনি আমরা ভুলেও যাই অনেক কিছু। মনে করা হয়, শৈশবের স্মৃতি বিলুপ্তির ব্যাপারটাও হয়তো এভাবেই ঘটে। উনিশ শতকে জার্মান মনোবিজ্ঞানী হারমান এবিংহজ বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, ‘মানুষ যত নতুন জিনিস শেখে, প্রতি ঘণ্টায় তার অর্ধেক মুছে ফেলে মস্তিষ্ক। এভাবে ৩০তম দিনে মস্তিষ্কে অবশিষ্ট থাকে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ স্মৃতি।’

একেকজনের স্মৃতিশক্তিও একেক রকম। কেউ কেউ মাত্র দুই বছর বয়সের ঘটনা মনে করতে পারেন, আবার কেউ নিজের সাত-আট বছর বয়সের কোনো ঘটনাও বেমালুম ভুলে যান। এই ধাঁধার সমাধান খুঁজতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী কি ওয়াং কয়েক শ ছাত্রছাত্রীর স্মৃতির তথ্য সংগ্রহ করেন। সেগুলো বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান, যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের স্মৃতির বিবরণ চীনা ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় লম্বা হয়ে থাকে।

নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী মাওরি জনগোষ্ঠী নিজেদের অতীতকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাদের অনেকে আড়াই বছর বয়সের স্মৃতিও সযত্নে ধরে রাখে। একদল গবেষক মনে করেন, স্মৃতির বিবরণ প্রকাশে ভাষার তাৎপর্য অনেক। এটা স্মৃতিকে সুসংবদ্ধ করে একটা বিশেষ রূপ দেয়। এভাবে একটা গল্প তৈরি হয় এবং তা মস্তিষ্কে থেকে যায়। তবে এই ধারণার যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দিহান আরেক দল গবেষক। 

গবেষকদের একটি অংশ মনে করে, শৈশবে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস নামের অংশটি সুগঠিত থাকে না বলেই তখনকার অনেক স্মৃতি সম্ভবত হারিয়ে যায়। আর যেগুলো অবশিষ্ট থাকে, তার অধিকাংশই ভুল এবং অবাস্তব হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (আরভিন) মনোবিদ এলিজাবেথ লফটাস বলেন, ‘লোকে অন্যের বলা কথা শুনে শুনে মনের মধ্যে একধরনের ছবি তৈরি করে নিতে পারে। আর সেটাই একসময় স্মৃতির মতো মনে হতে পারে। আবার সত্যি ঘটনার স্মৃতিও অনেক সময় অতিরঞ্জিত হয়ে যেতে পারে।