দুই কলেজের বৈপরীত্য যেন ইউরোপের প্রতিচ্ছবি

প্রতীকী ছবি

মানুষ যে লকডাউনের মতো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না, এটা সত্যি। তবে নেদারল্যান্ডসের হারম্যান উয়েসলিংক কলেজের পরিস্থিতি দেখলে মনে হবে, তারা আগে থেকেই লকডাউন বিষয়ে অবগত ছিল! গত ডিসেম্বরে আমস্টারডামের বিদ্যালয়টি বন্ধ ঘোষণা হওয়ার আগে প্রয়োজনের চেয়ে কিছুটা বেশিই প্রস্তুত ছিল।
দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই কলেজের অর্ধেক শিক্ষার্থীর মা-বাবাই উচ্চশিক্ষিত। প্রায় সব শিক্ষার্থীর পড়াশোনাবান্ধব একটি শোবার কক্ষ আছে। এর মধ্যে স্কুলের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের একটি করে ল্যাপটপ দেওয়া হয়। নেদারল্যান্ডসে গত বসন্তে লকডাউন শুরুর পর থেকে দূরবর্তী পাঠদান শুরু হয়। ওই বিদ্যালয়ের পরিচালক বলেন, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দক্ষতা খানিকটা কমেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা পিছিয়ে পড়েনি।

নেদারল্যান্ডসে এই কলেজের উল্টো চিত্রও আছে। আমস্টারডাম শহরের কাছেই দ্য মুন্ডুস কলেজ। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীই অভিবাসী বা শরণার্থী। তাদের উচ্চশিক্ষিত বাবা-মা নেই, নেই বাড়িতে বসে পড়াশোনা করার পরিবেশও। যদিও বলার অপেক্ষা রাখে না—তাদের বলার মতো বাড়িই–বা আছে কোথায়! বাড়িতে বসে দূরবর্তী শিক্ষার মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা নেওয়াটাও তো সহজ নয়। উপায় না পেয়ে অর্ধেক শিক্ষার্থীকে নিয়ে ক্লাস চালু রাখে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু নার্সিংয়ের মতো বিষয়ে পাঠদানের সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ছিল প্রায় অসম্ভব। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডায়ানা ব্রুম্মেলহুইস বলেন, ‘লেকচারের মাধ্যমে আপনি কাউকে হুইলচেয়ার ধরা শেখাতে পারবেন না।’ তাঁর মতে, স্বাভাবিকের চেয়ে তাঁর শিক্ষার্থীরা এক-চতুর্থাংশ পিছিয়ে রয়েছে।

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন বলছে, করোনাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে ইউরোপজুড়েই এমন বৈপরীত্য দেখা গেছে। সমৃদ্ধিশালী একটা মহাদেশে স্কুল বন্ধ হওয়াটা একটা হুমকির মতো। বিশেষ করে শিক্ষার বিভাজনসহ জাতি ও শ্রেণির বিভাজন বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে। গত শরতের শুরুতেই ইউরোপের কোনো কোনো দেশে সীমিত পরিসরে স্কুল খুলে দেওয়া হয়। একই সময়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ স্কুল বন্ধ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ইউরোপের স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য করে।
স্কুল বন্ধ হওয়ায় বেশির ভাগ সাধারণ শিক্ষার্থী কষ্ট পেয়েছে। তবে বেশি কষ্ট পেয়েছে গরিব এবং ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীরা।

ফ্রান্সে মাস্ক পরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে স্কুলে ক্লাস করছে শিশুরা। ছবিটি গত ১ সেপ্টেম্বর তোলা। ইউরোপের বেশ কিছু দেশ ওই সময় সীমিত পরিসরে স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়
ফাইল ছবি: এএফপি

ফ্রান্সের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বসন্তের লকডাউন শহরের স্কুলের সঙ্গে দুর্গম এলাকার স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফলের নম্বরে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। জার্মানি তো রীতিমতো হিসাব করে বলে দিয়েছে, লকডাউনের কারণে দেশটির শিক্ষার্থীদের দৈনিক গড় পড়াশোনার সময় ৭ দশমিক ৪ ঘণ্টা থেকে কমে ৩ দশমিক ৬ ঘণ্টায় এসে ঠেকেছে। নেদারল্যান্ডসে গত বছরের পরীক্ষার ফলাফলের ওপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনের সময় সেখানকার শিক্ষার্থীরা বলার মতো কিছুই শেখেনি। যেসব শিক্ষার্থীর বাবা-মা কম শিক্ষিত, তাদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্কুল বন্ধ না করার ক্ষেত্রে ফ্রান্স তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। ফরাসিদের কাছে স্বাস্থ্যের ঝুঁকির চেয়ে পড়াশোনা শেখা ও সামাজিক বন্ধনের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের উপদেশ অগ্রাহ্য করে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁখো স্কুল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবু নভেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের বেশির ভাগ উচ্চবিদ্যালয় শিফট করে চলছিল। ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানিতে গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশির ভাগ স্কুল বন্ধ ছিল। জার্মানির রাজ্য সরকারগুলো স্কুল খুলে দেওয়ার পক্ষে হলেও চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল করোনার প্রাদুর্ভাব বর্তমানের চেয়ে অর্ধেকে নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইছেন। ইউরোপে সবচেয়ে ব্যতিক্রম ছিল সুইডেন। দেশটিতে শুধু গত জানুয়ারিতে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউনের ফলে মানবিক অনুভূতি ও বিকাশের ক্ষতি হয়েছে। যদিও তথ্যটি নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। কারণ, ডাচ সামাজিক কর্মীদের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে শিশুদের প্রতি মানসিক অবহেলার তুলনায় গত বছরের অবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। অনেক শিশু বলছে, তারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে কম আদর পাচ্ছে। অনেকে বলছে, লকডাউনের সময়ে তারা আগের চেয়ে বেশি আদর পাচ্ছে।

ইকোনমিস্টের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইডেনের মতো স্পেনও স্কুল বন্ধের পক্ষে ছিল না। স্পেনের বেশির ভাগ স্কুলই শরৎ পর্যন্ত খোলা ছিল। তবে অনেক উচ্চবিদ্যালয় দূরবর্তী শিক্ষাকার্যক্রম চালায়। শ্রেণিকক্ষের আকার ছোট করতে দেশটিতে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। ইতালিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করা হয়নি। উচ্চবিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয় নভেম্বরে। বেশ কিছু ক্লাস পুনরায় খুলেও দেওয়া হয়েছে। দুই দেশই দূরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেয়েছে। তাদের ইন্টারনেটসেবা ও দরিদ্র অভিভাবকদের মধ্যে কম্পিউটারের অপ্রতুলতা এর অন্যতম কারণ।

একই রকমের প্রযুক্তি ঘাটতি অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পূর্ব ইউরোপেও আছে। তবু সেখানকার স্কুলগুলো কঠোরভাবে বন্ধ ছিল। পোল্যান্ডে স্কুলগুলো অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত বন্ধ ছিল। আট বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের স্কুল জানুয়ারির মাঝামাঝি চালু হয়। এদিকে রোমানিয়ার স্কুল গত বছরের মার্চেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত মাসের শুরুতে স্কুল খোলার ঘোষণা দেয় দেশটি। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, রোমানিয়ার এক–চতুর্থাংশের বেশি শিশুর অনলাইন শিক্ষায় অংশ নেওয়া সুবিধা নেই। জানুয়ারি পর্যন্ত রোমানিয়ার সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ট্যাবলেট বিতরণ করে। এরপরও এখনো ২ লাখ ৮৭ হাজার শিক্ষার্থীর ট্যাবলেট প্রয়োজন।

ইউরোপে প্রায় ছয় মাস পর গত সেপ্টেম্বরে শিশুদের জন্য বন্ধ স্কুলের দরজা খুলছে
ফাইল ছবি: এএফপি

বিশেষজ্ঞদের মতে, লকডাউনের ফলে মানবিক অনুভূতি ও বিকাশের ক্ষতি হয়েছে। যদিও তথ্যটি নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। কারণ, ডাচ সামাজিক কর্মীদের এক জরিপে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে শিশুদের প্রতি মানসিক অবহেলার তুলনায় গত বছরের অবস্থা অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। অনেক শিশু বলছে, তারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে কম আদর পাচ্ছে। অনেকে বলছে, লকডাউনের সময় তারা আগের চেয়ে বেশি আদর পাচ্ছে। অনেকে আবার কর্মক্ষেত্রে যাওয়া বাবা-মা যারা লকডাউনের কারণে ঘরে বসে আছেন, তাঁদের নিয়ে চিন্তিত। অর্থনীতিবিদ পিওতর লেভানডভস্কির মতে, করোনার সময়ে পোল্যান্ডের দেড় লাখ কর্মজীবী নারী কাজ হারিয়েছেন।

সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, রোমানিয়ার এক–চতুর্থাংশের বেশি শিশুর অনলাইন শিক্ষায় অংশ নেওয়া সুবিধা নেই। জানুয়ারি পর্যন্ত রোমানিয়ার সরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২ লাখ ৫০ হাজার ট্যাবলেট বিতরণ করে। এরপরও এখনো ২ লাখ ৮৭ হাজার শিক্ষার্থীর ট্যাবলেট প্রয়োজন।

ইউরোপের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন একটাই ইস্যু—জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাগুলোর কী হবে? জার্মানিতে এ বছর গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ফলাফলের ক্ষেত্রে সমতার কথা ভাবা হচ্ছে। ডাচ উচ্চবিদ্যালয়গুলো তাদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষার আগপর্যন্ত খোলা রাখা হয়েছে। ফ্রান্সে চার ঘণ্টার ব্যাচেলর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। তবে অনেকের জন্য মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস গত মাসেই তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় সীমিত পরিসরে খুলে দিয়েছে। রোমানিয়াও একই পথে হেঁটেছে। তবে চলতি মাসে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে এই দেশগুলো কী করবে, তা স্পষ্ট নয়।