বিরোধীদেরও সরকারে ডাকছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া

গোতাবায়া রাজাপক্ষে

শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংকট থেকে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট দিন দিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বিক্ষোভের মুখে গত রোববার রাতে দেশটির মন্ত্রিসভার ২৬ জন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। সংকট সমাধানে বিরোধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তাতেও কাজ হচ্ছে না। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ এবং রাজাপক্ষে পরিবারের আধিপত্যের অবসান চাইছেন বিক্ষোভকারীরা।

শ্রীলঙ্কার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে রোববার দিবাগত রাতে বৈঠকে বসে মন্ত্রিসভা। সেখানেই ২৬ মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। তাতে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছাড়া মন্ত্রিসভায় আর কেউ নেই।

মন্ত্রীদের গণপদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে গতকাল বিরোধীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন। তাঁর কার্যালয়ের পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া সব দলের নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় সংকট মোকাবিলার জন্য তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য থেকে সংকট সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করা উচিত।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে শ্রীলঙ্কা। এরপর এবারই সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে দেশটি। বর্তমান সরকারও এই সংকটের কথা স্বীকার করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটিতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

পদত্যাগ করেছেন গভর্নর

মন্ত্রিসভার সদস্যদের পর গতকাল সোমবার শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিত নেভার্দ কেবরালও পদত্যাগ করেছেন। এক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘মন্ত্রিসভার সবার পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে আমি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।’

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গভর্নরের দায়িত্বে আসেন অজিত। ক্ষমতাসীন দলের সদস্যও তিনি। এর আগে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যখন মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনো গভর্নর ছিলেন তিনি। সম্প্রতি দেশটির পরিস্থিতি নিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে একটি সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেন, গত দুই বছরে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতের আয় ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার কমেছে। রেমিট্যান্স কমেছে ১৫০ কোটি ডলার।

নতুন মন্ত্রিসভায় চারজন

২৬ মন্ত্রীর পদত্যাগের পর গতকালই নতুন করে চারজনকে মন্ত্রী করেছেন গোতাবায়া। সরকারের সার্বিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য এই চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের দুজন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

চার মন্ত্রীর মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন এত দিন বিচারবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসা আলি সাব্রি। এত দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন গোতাবায়ার ভাই বাসিল রাজাপক্ষে। জি এল পেরেজ আবারও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। এ ছাড়া দিনেশ গুনাওয়ারদেনা শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। আর জনস্টন ফার্নান্দো হয়েছেন মহাসড়ক বিষয়কমন্ত্রী।

নতুন দায়িত্ব পাওয়ার পর দিনেশ গুনাওয়ারদেনা বলেন, নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে দায়িত্ব পালন করবেন তাঁরা।

বিক্ষোভে ক্রিকেট তারকারা

শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভ এখনো চলছে। মূলত গোতাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে সড়কে অবস্থান করছেন বিক্ষোভকারীরা। জরুরি অবস্থা উপেক্ষা করে গতকালও সারা দেশের সড়কে ছিলেন তাঁরা।

বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে স্লোগান দিলেও কোনো ধরনের সহিংসতায় জড়াননি। এই বিক্ষোভে সমর্থন দিচ্ছেন দেশটির ক্রিকেট তারকারা। মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছেন, বর্তমান সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নেই। সত্যিকারের নেতারা নিজেদের ভুল স্বীকার করেন।

আরেক ক্রিকেট তারকা কুমারা সাঙ্গাকারা বলেছেন, একেকজন মানুষ, একেকটি পরিবার হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, এমন দৃশ্য হৃদয়বিদারক।

সাঙ্গাকারার স্ত্রী ইয়েহালি সরাসরি এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। বিক্ষোভে যোগ দিয়ে গতকাল তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি কারণ বর্তমান সরকার তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

সংকট যেভাবে শুরু

শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালে তিনটি হোটেল ও তিনটি গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে মৃত্যু হয় ২৫৩ জনের। এরপর পর্যটনে ধস নামে। ওই বছরই পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) কমানো হয়। এতে সরকারের আয় কমে যায়। এরপর আসে কোভিড-১৯-এর ধাক্কা। ২০২০ সালের মার্চ থেকে কোভিডের কারণে প্রবাসী আয়, পর্যটন, রপ্তানি—সবকিছুই কমে যায়।

শ্রীলঙ্কার কৃষি বড় ধাক্কা খায় ২০২১ সালে। এই বছর রাসায়নিক সার আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। সরকার চেয়েছিল, তারা বিশ্বের প্রথম দেশ হবে যারা কিনা ‘শুধু অর্গানিক’ উপায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদন করবে। ওই সময় প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, রাসায়নিক সার থেকে বেরিয়ে এলে ২০ কোটি ডলার খরচ কম হবে। কিন্তু এই তত্ত্ব কাজে আসেনি। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে ২৫ শতাংশ কৃষিজ উৎপাদন কমে যায়।

চলতি বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় আমদানিতে সংকট দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে বিদেশ থেকে আনা জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ওপরও। এরপর খাদ্যসংকট, বিদ্যুৎ–সংকটে অতিষ্ঠ হয়ে প্রেসিডেন্ট বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয় ১ এপ্রিল।