বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ধরন চারটি, তবে দাপট বেশি ডেলটার

ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনার নয়টি ধরনের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ডেলটা, গামা, বিটা ও আলফা সবচেয়ে উদ্বেগজনক।

করোনাভাইরাস।
প্রতীকী ছবি

চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়ার কয়েক মাস পর তার নাম দেওয়া হয় সার্স-কোভ-২। সেই থেকে প্রায় দেড় বছরে মিউটেশনের (রূপান্তরের) মাধ্যমে ভাইরাসটির বিভিন্ন ধরন (ভেরিয়েন্ট) নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বে করোনার নয়টি ধরনের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে ডেলটা, গামা, বিটা ও আলফা সবচেয়ে উদ্বেগজনক। তবে এখন পর্যন্ত বিশ্বে ডেলটা ধরনই বেশি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। এর সংক্রমণ ক্ষমতাও অন্যান্য ধরনের চেয়ে বেশি। ভারতে শনাক্ত হওয়ার প্রায় ৯ মাসের মধ্যেই ডেলটা ১৪২ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

করোনা মহামারি বিষয়ে ডব্লিউএইচওর সাপ্তাহিক হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হয় গত মঙ্গলবার। তাতে বলা হয়েছে, গত বছরের অক্টোবরে ডেলটা ধরন প্রথম শনাক্ত হয় ভারতে। এ ধরনের কারণে ভারতে নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে সেই ধরন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে করোনা পরিস্থিতির যখন বেশ খানিকটা উন্নতি হচ্ছিল, তখন ডেলটার কারণে আবারও সংক্রমণ বেড়েছে।

গত সপ্তাহে জেনেভায় সংবাদ ব্রিফিংয়ে ডব্লিউএইচওর মহামারি বিশেষজ্ঞ ম্যারি ভ্যান কারখভ ডেলটার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এরপর এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া করোনার ধরনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংক্রামক হচ্ছে ডেলটা। ডেলটা ধরন এতটাই শক্তিশালী যে করোনার টিকা ও চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসছে না। এ ধরনে আক্রান্ত হলে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকিও বেশি।

১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে আলফা। বিটা ধরন ছড়িয়েছে ১৩৬টি দেশে। গামা ছড়িয়েছে ৮১টি দেশে। ডেলটা ১৪২ দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

সংক্রমণের দিক থেকে ডেলটা যে ভয়াবহ, তার প্রমাণও মিলেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসির খবরে বলা হয়েছে, গত চার সপ্তাহে শুধু যুক্তরাজ্যেই ৫৮ হাজার ২৬৮ জন ডেলটা ধরনে সংক্রমিত হয়েছেন। এ নিয়ে দেশটিতে ডেলটা সংক্রমণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ২৬৬। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ হাজার ৬৬২ জনের শরীরে ডেলটা ধরন শনাক্ত করা হয়। এ নিয়ে দেশটিতে ডেলটায় মোট শনাক্ত রোগী ৪৫ হাজার ৮১৮ জন। এ ছাড়া ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে ডেলটার সংক্রমণ বাড়ছে। জার্মানির মিউনিখভিত্তিক অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিআইএসএআইডির কাছে পাঠানো করোনায় আক্রান্তের নমুনা পরীক্ষা করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেলটার বিষয়ে সতর্ক প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগোর লা জোলা ইনস্টিটিউট ফর ইমিউনোলজির ভাইরাস বিশেষজ্ঞ শেন ক্রোটি বলেছেন, সংক্রামক হিসেবে ডেলটার ব্যাপক ক্ষমতা। আর চীনে গবেষণায় দেখা গেছে, অন্যান্য ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চেয়ে ডেলটা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের নাকে ১ হাজার ২৬০ ভাগ বেশি ভাইরাস পাওয়া গেছে।

তবে ডেলটার চেয়ে বেশি দেশে ছড়িয়েছে আলফা ধরন। এই ধরন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হয়। ডব্লিউএইচওর সাপ্তাহিক হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়েছে আলফা। আর গত বছরের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া বিটা ধরন ছড়িয়েছে ১৩৬টি দেশে। ব্রাজিলে সবচেয়ে বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টিকারী করোনার ধরন গামা। ২০২০ সালের নভেম্বরে ব্রাজিলে প্রথম শনাক্ত হওয়া গামা ছড়িয়েছে ৮১টি দেশে। আশার কথা হচ্ছে, গত সপ্তাহ থেকে এই ধরন নতুন কোনো দেশে শনাক্ত হয়নি।

এ ছাড়া করোনা আরও কিছু ধরন আলোচনায় এসেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইটা (নাইজেরিয়া), লোটা (যুক্তরাষ্ট্র), কাপ্পা (ভারত), লাম্বডার (পেরু) নাম উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর মধ্যে লাম্বডাকে সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছিল। গত ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে এটা প্রথম শনাক্ত হয়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এর সংক্রমণ হার কমছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও মলিকুলার মেডিসিনের অধ্যাপক এরিক টপোল বলেছেন, জিআইএসএআইডির করোনার নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, লাম্বডা ধরনের সংক্রমণ কমছে। এতে মনে হচ্ছে, ধরনটি শক্তি হারাচ্ছে।

তবে বিশ্বজুড়ে এখনো সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। করোনা পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশকারী ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস জানিয়েছে, গত সপ্তাহের চেয়ে এ সপ্তাহে বিশ্বে সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ ও মৃত্যু ২ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত এবং ৬৬ হাজার ৮২৮ জনের মৃত্যু হয়। সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, ২৫ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ৮ শতাংশ, ইরানে ১৪ শতাংশ, তুরস্কে ১০ শতাংশ। অঞ্চল ভিত্তিতে সংক্রমণ বাড়ার চিত্রও তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে দেখা গেছে, সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমেরিকা অঞ্চলে, ১৪ শতাংশ, ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক অঞ্চলে ১৯ শতাংশ। গতকাল বুধবার রাত আটটা পর্যন্ত সারা বিশ্বে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ২০ কোটি ৪৯ লাখ ৯৮ হাজার ১৯৮ জন। মারা গেছেন ৪৩ লাখ ৩১ হাজার ১৭৭ জন। সুস্থ হয়েছেন ১৮ কোটি ৪১ লাখ ১৩ হাজার ৫৮২ জন।