ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন সুখরঞ্জন বালি

সুখরঞ্জন বালি
সুখরঞ্জন বালি

মানবতাবিরোধী অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন জামায়াতে ইসলামীর নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পক্ষের অন্যতম সাক্ষী সুখরঞ্জন বালি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। সুখরঞ্জনের এক ভ্রাতুষ্পুত্রের বরাত দিয়ে এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে বিবিসি বাংলা। সুখরঞ্জন এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এক কারাগারে বন্দী আছেন।

বিবিসি বাংলা আজ সোমবার জানিয়েছে, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে সাজা ভোগের পর যেন তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হয়, সে জন্য ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নতুন করে আবেদন করেছেন সুখরঞ্জন।

এর আগে সুখরঞ্জন ও তাঁর পরিবার কলকাতা হাইকোর্টের কাছে একই আবেদন জানিয়েছিল; তবে আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দিয়েছিলেন। সে সময় সুখরঞ্জনের পরিবার ও আইনজীবীরা বলেছিলেন, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাঁকে হেনস্তা ও হয়রানি করতে পারে। কলকাতা হাইকোর্ট সুখরঞ্জনের ভ্রাতুষ্পুত্রের করা আবেদন খারিজ করে বলেছিলেন, সুখরঞ্জনের পরিবার তাদের আশঙ্কার কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারেনি।

রাজনৈতিক আশ্রয়

সুখরঞ্জন বালির বড় ভাইয়ের ছেলে বাসুদেব বালা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, তাঁর কাকা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন।

সুখরঞ্জনের আইনজীবী জানিয়েছেন, রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের সঙ্গে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে আগামীকাল মঙ্গলবার যে আবেদন জমা দিতে যাচ্ছেন, তাও জুড়ে দিয়েছেন। আইনজীবীরা বলেছেন, ওই আবেদনে সুখরঞ্জনের ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার কারণ ও ভিত্তি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আইনজীবীরা আশা করছেন, মামলাটি এ সপ্তাহেই শুনানির জন্য উঠবে।

কলকাতা হাইকোর্ট গত সপ্তাহে এক আদেশে বলেছিলেন, ২০ আগস্ট পর্যন্ত সুখরঞ্জন বালিকে দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। কিন্তু তারপর সংশ্লিষ্ট দপ্তর সিদ্ধান্ত নেবে যে কবে কীভাবে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে।

বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, ওই সবই তাঁদের অনুমান, আর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্ত আদালত দিতে পারেন না।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আটক সুখরঞ্জন

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) সুখরঞ্জনকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার স্বরূপনগর এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রাতে আটক করে।

বিএসএফ তাঁকে ২৫ ডিসেম্বর স্বরূপনগর থানার হাতে তুলে দেয়। পরদিন, অর্থাত্ ২৬ ডিসেম্বর তাঁকে আদালতে পেশ করা হয় অবৈধভাবে সীমানা অতিক্রম করার অভিযোগে। ভারতের বিদেশি নাগরিক আইন ১৯৪৬-এর ১৪এ ও ১৪সি ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বশিরহাটের দ্বিতীয় অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট গত ৩ এপ্রিল সুখরঞ্জনকে ১০৫ দিনের কারাদণ্ড দেন ও ৫০০ টাকা জরিমানা করেন। মাঝের সময়টুকু তিনি জেল হেফাজতেই ছিলেন।

আদালতের রায়ে বলা হয়, আটক থাকা ও বিচার চলাকালে সুখরঞ্জন  যে সময়টা জেলে থেকেছেন, সাজার মেয়াদ থেকে সে সময়টা বাদ দেওয়া হবে। জেলের মেয়াদ শেষে তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দেন আদালত। এই হিসাবে এপ্রিলের ৬ তারিখেই সুখরঞ্জনের সাজার মেয়াদ পূর্ণ হয়। তবে এর পরও তিনি ভারতের কারাগারে বন্দী আছেন।

বাংলাদেশের দৈনিক ‘নিউ এজ’ সুখরঞ্জনকে নিয়ে গত ১৬ মে প্রথম সংবাদ প্রকাশ করে। ওই সময় পত্রিকাটি দাবি করেছিল, সুখরঞ্জন বালি বাংলাদেশে জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর যুদ্ধাপরাধের মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন এবং গত বছরের ৫ নভেম্বর বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে তুলে নিয়ে যায়।

‘নিউ এজ’-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সুখরঞ্জন ভারতের এক ব্যক্তির কাছে এ বক্তব্য দেন যে, বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাঁকে অপহরণ করে বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। ‘নিউ এজ’ দাবি করেছিল, সুখরঞ্জনের বক্তব্যের কপি তার কাছে আছে।

গত ১৬ মে বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটের স্বরূপনগর থানায় সুখরঞ্জন বালির বিরুদ্ধে যে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন (এফআইআর) দাখিল করা হয়েছিল, তার কোথাও এমন কথা উল্লেখ নেই যে, তাঁকে কেউ অপহরণ করেছিল বা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে।

বিবিসি বাংলা জানায়, স্বরূপনগর থানায় সুখরঞ্জন বালির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন বিএসএফের ১৫২ নম্বর ব্যাটালিয়নের ১ কোম্পানির অধিনায়ক বি পি সিং।

এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি নাগরিক সুখরঞ্জন বালি আমুদিয়া সীমান্ত চৌকির কাছে সন্দেহজনকভাবে ঘুরছিলেন। তখন বিএসএফ তাঁকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পরে ধরা পড়ে যান।

জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে সুখরঞ্জন বালি বিএসএফের কাছে স্বীকার করেন, তিনি বনগাঁয় তাঁর বড় ভাই পরিতোষ বালির বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।

তবে পশ্চিমবঙ্গের কারা বিভাগের প্রধান রনভীর কুমার বিবিসিকে বলেন, ‘জেলে থাকা কোনো বাংলাদেশি বন্দীর সঙ্গে দেখা করে তার বিবৃতি নেওয়া এবং সে বিবৃতি কোনো বিদেশি কাগজের হাতে পৌঁছে দেওয়াটা প্রায় অসম্ভব।’ তবে সুখরঞ্জনের খবরটি জানার পর তিনি ‘আরও একটু খোঁজখবর করেন এবং গোয়েন্দাসূত্রে’ জানতে পারেন ‘দমদম জেল কর্তৃপক্ষ’ সুখরঞ্জনকে ইতিমধ্যে জেরা করেছে এবং তিনি জেলের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেই অর্থের লোভ দেখিয়ে এক জেলরক্ষীকে দিয়ে ওই বিবৃতি বাইরে পাঠিয়েছিলেন।

রনভীর বলেন, সুখরঞ্জন ‘ওই জেলরক্ষীকে বলেছিলেন যে, তাঁর বক্তব্য নিজের দেশে, অর্থাত্ বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়া দরকার। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে এক চোরাচালানকারীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন বালি।’

ভারতের গোয়েন্দাসূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানায়, সুখরঞ্জনের ‘কথামতো ওই জেলরক্ষী বিবৃতিটি নিয়ে সীমান্তে যান এবং বলে দেওয়া চোরাচালানকারীর হাতে সেটি তুলে দেন। প্রতিশ্রুতিমতো টাকাও তিনি পেয়ে যান।’

বিবিসি আরও জানায়, ওই জেলরক্ষীর নাম জানা যায়নি, কিন্তু তাঁকে জেল কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করতে পেরেছে আর তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’