মুসলিমবিরোধী ভিক্ষুদের সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমার

বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিরাথু
বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিরাথু

মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উগ্রপন্থী আন্দোলন পরিচিত ৯৬৯ নামে। একেবারে তৃণমূল থেকে ওই আন্দোলন যিনি গড়ে তোলেন তিনি হলেন ভিরাথু। তাঁকে ডাকা হয় ‘বার্মিস বিন লাদেন’ নামেও। ভিরাথু মিয়ানমারে মুসলিমদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বয়কট করেছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আত্মীয়তা করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। তিনি মসজিদগুলোকে শত্রুর ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করেন। মিয়ানমারে বিভিন্ন সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তাতেও ভিরাথুর নাম এসেছে বারবার।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক দাঙ্গায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ভিরাথুকে নিয়ে ‘দ্য ফেস অব বুড্ডিস্ট টেরোরিস্ট’ (এক বৌদ্ধ সন্ত্রাসীর মুখ) শিরোনামের এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘টাইম’ সাময়িকী। ‘টাইম’-এর জুলাই মাসের সংখ্যার প্রচ্ছদে ভিরাথুর একটি ছবিও ছাপা হয়েছে।
রয়টার্সের অনুসন্ধান বলছে, ৯৬৯-এর আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে মিয়ানমারের বর্তমান সরকার। সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ৯৬৯-এর আন্দোলনে অংশ নেওয়া বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির নেতারাও সমর্থন দিচ্ছেন ওই আন্দোলনকে।
মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী স্যাস সিন্ট এক সাক্ষাত্কারে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, ভিরাথু সারমন বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে ভালোবাসা ও সমঝোতা জাগিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেন, এটা হতেই পারে না যে ওয়ারাথু ধর্মীয় সহিংসতাকে উসকে দেবেন। মিয়ানমারের ধর্মমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্যান সিন্ট বলেন, মুসলিম ব্যবসা বয়কটের পেছনেও তিনি কোনো অযৌক্তিকতা দেখেন না। তিনি বলেন, আমরা এখন বিশ্ব অর্থনীতির চর্চা করছি। কেউ আমাদের থামাতে পারবে না। এটা নির্ভর করবে বিক্রেতাদের ওপর।
দেশটির প্রেসিডেন্ট থিয়েন শিয়েনও ৯৬৯-এর আন্দোলনের প্রতি অনেকটা সহানুভূতিশীল। তবে এ বিষয়ে তাঁর কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। ৯৬৯-এর আন্দোলন নিয়ে চলমান বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়, ৯৬৯ শান্তির প্রতীক। আর ভিরাথু হলেন বুদ্ধের সন্তান।
তবে যে যা-ই বলুক এটা সত্য যে মিয়ানমারে সহিংসতা বাড়ছে। গত বছর রাখাইন রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে দুটি সহিংসতার ঘটনায় ১৯২ জন নিহত হন ও ১৪ লাখ মানুষ গৃহহারা হন। এ বছরের মার্চে মায়েখতিলায় সহিংসতায় নিহত হন ৪৪ জন মুসলিম নাগরিক, গৃহহারা হন ১৩ হাজার মানুষ। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে মিয়ানমারের রাজনীতির সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। ২০০৭ সালে জান্তা সরকারের শাসনকালে ‘শ্যাফরন বিপ্লবে’ তাঁরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সে সময়ে সরকারের জ্যেষ্ঠ নেতারা ভিক্ষুদের আড়াল করেন। মিয়ানমারে ২০১৫ সালে হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপের মধ্যে রেখেছেন ভিক্ষুরা। ২০০১ সালে বৌদ্ধদের হামলায় কমপক্ষে ১০ জন মুসলিম নিহত হন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ওই ঘটনার বছর দুই পরে ভিরাথুকে গ্রেপ্তার করে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারে মুসলিমদের প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। মুসলিমবিরোধী সহিংসতার দুই বছর পর ভিরাথুকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১১ সালে রাজনৈতিক বন্দীদের তালিকায় মুক্তি পান ভিরাথু। আবারও জেগে ওঠে ভিরাথুর কার্যক্রম। গত বছর থেকে তারা গোষ্ঠীগতভাবে তত্পরতা শুরু করে। গত বছর তারা মুসলিম মালিকানাধীন একটি বাস কোম্পানি বয়কট করে। বাস কোম্পানিটি মুলামেইনে অবস্থিত। পরে এই বয়কট শুরু হয় পুরো দেশজুড়ে।
কিন্তু শুরুতে অবস্থাটা অন্য রকম ছিল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হওয়ার পর মুসলিমরা মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সরকারি পদে ছিলেন। ১৯৬২ সালে গিয়ে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়। এ সময়ে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। সেনাবাহিনী সে দেশের জনগণের মধ্যে এমন মনোভাব জাগিয়ে তোলে যে মুসলিমরা মিয়ানমারের ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ব্যবসার লাভ খাটিয়ে তাঁরা মসজিদ তৈরি করছে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে করছে। এভাবে ইসলামি শাসন কায়েম করছে। এখানে ভাববার মতো বিষয় হলো, মুসলিমদের প্রতি বৌদ্ধরা কেন এ ধরনের মনোভাব পোষণ করছে? ধর্মীয় রীতিনীতির কারণে মুসলিমরা বৌদ্ধদের রেস্তোরাঁয় যায় না। এ কারণে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় মুসলিমদের আধিপত্য রয়েছে। মুসলিম মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারে ব্যবসায়িকভাবে সফর। যেমন- নায়িং গ্রুপ, মাদারল্যান্ড, ফাদারল্যান্ড। ফলে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে মুসলিমরা সফল হওয়ায় মিয়ানমারে তাঁদের প্রতি বৌদ্ধদের নেতিবাচক মনোভাব বাড়তে থাকে।
গত মার্চ মাসে ইউটিউবে দেওয়া এক বক্তৃতায় ভিরাথু বলেন, মুসলিমরা সুচির দলে আধিপত্য বিস্তার করছে। তিনি বলেন, যদি এনএলডির কার্যালয়গুলো দেখা যায়, তাহলে সেখানে দাড়িওয়ালা লোকের সংখ্যা বেশি দেখা যাবে। মিয়ানমারের মুসলিমদের অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, এনএলডির অনেকে ৯৬৯-এর সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে দলের মুখপাত্র নিয়ান ইউন বলেন, সবারই নিজের মতো করে চলার অধিকার রয়েছে। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে দল হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সব মিলে মিয়ানমারের পরিস্থিতি এটাই ইঙ্গিত করে যে, ৯৬৯-এর আন্দোলনের প্রতি সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনের পাল্লাটাই বেশি। এমনকি সু চির দলেও সে সমর্থন রয়েছে।