রমজানে দেশকে মিস করেন মন্ট্রিয়লের বাংলাদেশিরা

একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রডাকশন ম্যানেজার সালমা বেগম মন্ট্রিয়লে আছেন প্রায় ২০ বছর। দুই বছর ছাড়া প্রবাস জীবনে প্রতিবছরই তিনি রোজা করেছেন। তাঁর বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। পবিত্র রমজানে দেশকে খুব বেশি মিস করেন। বললেন, এখানে রমজানের আসা-যাওয়া বুঝতেই পারি না। কর্মব্যস্ত প্রবাস জীবনে নিজ হাতে রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভোররাতে সাহ্রি খান। আবার বিকেলে কাজ থেকে এসে ইফতারি তৈরি করেন। তবে সালমার কাছে দেশের ইফতারির মজাটাই আলাদা।
মন্ট্রিয়লের একটি নামী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন সিলেটের নাসরিন। কিছুদিন আগে তাঁরই স্পনসরে দেশ থেকে এসেছেন। কানাডায় স্বামীর সঙ্গে প্রথম রমজান। তাই এবারের রমজানের আনন্দটাই অন্য রকম বলে জানালেন নাসরিন। একই প্রতিষ্ঠানে আরও অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশি কাজ করেন। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ। সবাই প্রতিদিন রোজা রাখতে পারেন না। তবে বাসায় পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে সাহ্রি ও ইফতার করেন।
পড়াশোনা শেষ করে কাজে যোগ দিয়েছেন নাদিরা। একটি নামকরা ফার্মাসির ফার্মাসিস্ট তিনি। কাজে যোগ দেওয়ার চার মাসের মধ্যেই পবিত্র রমজান আর ঈদ। নতুন চাকরি, ভাবতেই পারেননি তাঁর বস রমজানের শেষ কয়েক দিনসহ ঈদ পর্যন্ত ১০ দিনের ছুটি দেবেন তাঁকে। বরিশালের মেয়ে নাদিরা এবার বাবা-মাকে তাঁর চাকরির অর্থ দিয়ে হজ করাবেন। ছুটি পেয়ে খুব খুশি তিনি। বললেন, ‘আমি কৃতজ্ঞ বসের প্রতি, তিনি আমার চাকরি জীবনের প্রথম ঈদটি পরিবারের সঙ্গে কাটাবার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
ফরিদপুরের ইকবাল কবীরের বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে। এবারের রমজানটা তাঁর কাছে বাবা হারানোর বেদনায় সিক্ত।
উত্তর আমেরিকায় এবার প্রতিদিন প্রায় ১৮ ঘণ্টা রোজা করতে হচ্ছে। রমজানের প্রথম দিকটায় মন্ট্রিয়লের আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। শেষের দিকে বেশ গরম পড়তে পারে। এরপরও কর্মব্যস্ত প্রবাসী মুসলমানদের অধিকাংশই রোজা রাখেন। সবার অনুভূতি একই, রমজান মাসে জন্মভূমিকে খুব মনে হয় তাঁদের। কাজ থেকে ছুটি নেওয়া, ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ, তার ওপর পুরো পরিবারকে নিয়ে প্রতিবছর রমজানে দেশে যাওয়ার আর্থিক সংগতি এখানকার অধিকাংশ লোকের নেই। একটি চেইন রেস্টুরেন্টে কর্মরত নোয়াখালীর এনামুল হকের মতে, ‘যেখানে যেমন সেখানে তেমন’ করেই জীবনকে মানিয়ে নিচ্ছি।
ট্যাক্সি চালান আবদুল আহাদ। মন্ট্রিয়লে আছেন ১২ বছর। বললেন, এর আগে তিনি নিউইয়র্কে ছিলেন। দেশের কথা মনে পড়ে। আবার রমজান মাসে নিউইয়র্কের কথাও খুব মনে পড়ে তাঁর। জ্যাকসন হাইটসে হাঁটলে কখনো মনে হতো, তিনি দেশেই আছেন। আবদুল আহাদ বলেন, বিকেলে জ্যাকসন হাইটসে বাংলাদেশের রকমারি ইফতারির ঘ্রাণ পাওয়া যেত। কিন্তু মন্ট্রিয়লে এ সুযোগ নেই। টরন্টোতে তাও কিছুটা পাওয়া যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানের জেরার্ড স্ট্রিট ও ডানফোর্থ ধীরে ধীরে বাঙালি পাড়া হয়ে গড়ে উঠছে। বাংলাদেশি ইফতারি পাওয়া যায়। কিন্তু মন্ট্রিয়লে হাজার হাজার মুসলমান বাস করলেও ইফতারি বিক্রির স্টল বা রেস্তোরাঁ হাতে গোনা।
আবদুল আহাদ বললেন, নোয়াখালীর চৌমুহনীর নারায়ণ রায়ের বানানো পেঁয়াজি, ছোলাভুনা আর ডালদার জিলাপির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। এই কদিন রাস্তাঘাট, দোকানপাটে যাঁদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, সবার মুখেই দেশে রমজান কাটানোর স্মৃতি শুনি। শুধু মুসলিম সমাজের লোকজনই নন, হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকজনও রমজান মাসে দেশে ইফতারি খাওয়ার স্মৃতির কথা এখানে-সেখানে বসা আড্ডায় বলেন।
এদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রমজানের শুরুতে দেশের সব মুসলমানের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বহুজাতিক সমাজই কানাডার ঐতিহ্য। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে কানাডার সব নাগরিকই সমান অধিকার নিয়ে বাস করে আসছে। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ দেশ আরও সমৃদ্ধিশালী হবে।’
প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বিভিন্ন ইফতার পার্টিতেও যোগ দেন। এ ছাড়া রমজানে অটোয়ায় পার্লামেন্ট ভবনে মন্ত্রিপরিষদ ও পার্লামেন্টে কর্মরত তাঁর সব মুসলিম সহকর্মী ও কর্মকর্তাদের সম্মানে ইফতার পার্টি দেন।
মন্ট্রিয়লে রমজান মাসে ইফতারির খাদ্যসামগ্রী সবচেয়ে বেশি তৈরি করেন ক্যাফে রয়্যালের মালিক মাসুদ সিদ্দিকী। তাঁর রেস্টুরেন্ট পুরো রমজান মাস বুকড থাকে বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার মাহফিলের জন্য। এ ছাড়া ব্যক্তিগত আয়োজনেও যাঁরা বড় আকারে ইফতার পার্টি দেন, সেখানেও তিনি খাবার তৈরি করেন। আশপাশের শহর থেকেও অর্ডার আসে তাঁর কাছে। এখানে বাংলাদেশিদের পরিচালনায় অনেক মসজিদ আছে, যাতে নিয়মিত মাসুদ সিদ্দিকী ও তাঁর স্ত্রীর রান্না করা সাহ্রির খাবার ও ইফতারসামগ্রী যায়।
মাসুদ জানালেন, এবারও রমজানে খুব ব্যস্ত তিনি। এ ছাড়া নগরীর পার্ক এক্সে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মানুষ-অধ্যুষিত এলাকার কিছু রেস্টুরেন্টে ইফতারসামগ্রী বিক্রি হয়। সেখানে ‘লা ফিউশন ডু ইন্ডিয়া’ রেস্টুরেন্টে গত বছর থেকে চালু হয়েছে নানা পদের প্যাকেজ ইফতারি বক্স। এর অন্যতম মালিক মাসুম রহমান জানান, তাঁদের তৈরি সুস্বাদু সতেজ ও তুলনামূলক সস্তা ইফতারসামগ্রী এখন মন্ট্রিয়লবাসীর কাছে খুব জনপ্রিয়।