সেনাঘাঁটিতে হামলায় ১৮০ বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধা নিহত: রাশিয়া

রাশিয়ার হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ইউক্রেনের সামরিক ঘাঁটি। গতকাল ইয়াভোরিভ শহরে।
ছবি: রয়টার্স

পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। এ ঘাঁটিতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সেনা কর্মকর্তারা ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিলেন। হামলায় ৩৫ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে ইউক্রেন। অন্যদিকে রাশিয়া বলেছে, ১৮০ জন বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে এ হামলার ঘটনা ঘটে।

এর আগের দিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে হামলার হুমকি দিয়েছিল রাশিয়া। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, রুশ বিমান থেকে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়েছে। হতাহত ব্যক্তিদের মধ্যে ন্যাটোর কোনো সদস্যদেশের সেনা আছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

পোল্যান্ড সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো দূরে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের ইয়াভোরিভ শহরে এ সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত। পোল্যান্ড ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পোল্যান্ড সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে।

হামলার পর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকোভ এক টুইটে বলেন, ‘ইইউ-ন্যাটো সীমান্তের কাছে শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর এটা নতুন সন্ত্রাসী হামলা।’

এ হামলার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। হামলার ঘটনাকে চলমান সংঘাতের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেছে যুক্তরাজ্য। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান পশ্চিমা সামরিক জোটের কোনো সদস্যদেশের সীমানায় এলে ন্যাটো তার সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে।

প্রথমবারের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধে ন্যাটোর সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেই দুদা। গতকাল বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে ন্যাটো এ যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা পুনর্বিবেচনা করবে।

এ ঘাঁটিতেই ন্যাটোর সম্পৃক্ততা

হামলার শিকার সামরিক ঘাঁটিটি ২০০৭ সালে শান্তিরক্ষা ও নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পিসকিপিং অ্যান্ড সিকিউরিটি—আইপিএসসি) নামে গড়ে তোলা হয়েছিল। ৩৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা এ সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে ১ হাজার ৭৯০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। হামলার সময় সেখানে কতজন ছিলেন, তা জানা যায়নি। হামলার পর ১৯টি অ্যাম্বুলেন্সকে সাইরেন বাজিয়ে ওই কেন্দ্রের দিকে যেতে দেখেছেন রয়টার্সের সাংবাদিক।

আঞ্চলিক গভর্নর মাকসিম কোজিৎস্কি বলেছেন, রুশ বিমান থেকে ৩০টির মতো রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছে এ সামরিক ঘাঁটিতে। সেগুলোর কয়েকটি আকাশেই লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হয়েছে। হামলায় অন্তত ৩৫ জন নিহত এবং ১৩৪ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে বিদেশি কোনো প্রশিক্ষক আছেন কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ কেন্দ্রে সাধারণত ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং ন্যাটো সদস্যদেশগুলোর সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া হয়ে থাকে। ন্যাটোর সদস্য ও ন্যাটো–বহির্ভূতদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চালু করা ‘পার্টনারশিপ ফর পিস’ কর্মসূচির আওতায় এসব সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে প্রকাশিত ছবিতে এ ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রশিক্ষকদের ইউক্রেন বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মহড়ায় অংশ নিতে দেখা গেছে।

সেনাঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কথা জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাশেঙ্কোভ। তিনি বলেছেন, রুশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও প্রশিক্ষণের জন্য এ সামরিক ঘাঁটি ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব সমরাস্ত্র আসছিল, সেগুলোও এখানে সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। এই রুশ কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউক্রেন সীমান্তে যেসব বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধা আসবে, তাদের ওপর আমরা হামলা চালিয়ে যাব।’

বিবিসি বলছে, ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক সেনাসদস্যদের সামরিক অনুশীলনের দুটি কেন্দ্র রয়েছে। তার একটি আইপিএসসি। সামরিক ঘাঁটিটি তৈরির সময় মূল লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, বিশেষত শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য প্রস্তুত করা।

এ সামরিক ঘাঁটি থেকে ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের বড় শহর লিভিভের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটারের মতো। রাশিয়ার হামলা শুরুর পর দেশত্যাগী মানুষের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে লিভিভ শহর।

আরও হামলা

রাজধানী কিয়েভের কাছের ছোট শহরগুলো ঘিরে অবস্থান নেওয়া রুশ সেনাদের সঙ্গে ইউক্রেন বাহিনীর গোলাগুলি চলছে। গতকাল কিয়েভের উপকণ্ঠের ইরপিন শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ব্রেন্ট রেনাউড নিহত হয়েছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রথম সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রাণ হারালেন। এ হত্যাকাণ্ডের পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় আরেক শহর ইভানো-ফ্রাঙ্কিভস্কের বিমানবন্দরে গতকাল হামলা হয়েছে। সেখানে কেউ হতাহত হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি।
পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সেনারা ইউক্রেন বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছেন। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মারিউপোল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের খারকিভ থেকে রুশ সেনারা সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বলে গতকাল যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে হামলা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের চেরনিহিভ শহরে গতকাল একটি নয়তলা ভবনে রুশ হামলায় অন্তত একজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মিকোলেইভ শহরে গতকাল বিমান হামলায় নয়জন নিহত হয়েছেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বলছেন, ক্রিমিয়া থেকে এগিয়ে আসা রুশ সেনারা মিকোলেইভ ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছেন। এরপর তাঁরা পাশের ওডেসা দ্বীপের দিকে এগোতে চান।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ বন্দরনগরী মারিউপোলে ধারাবাহিকভাবে বোমা হামলা হচ্ছে। গতকাল স্থানীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ২২টি হামলা হয়েছে। সেখানে ২ হাজার ১৮৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে গতকাল নগর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, অভিযানে এ পর্যন্ত ইউক্রেনের ৩ হাজার ৬৮৭টি সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউক্রেনের ৯৯টি এয়ারক্র্যাফট, ১ হাজার ১৯৪টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান এবং ৪৪৩টি আর্টিলারি সিস্টেম ধ্বংস করেছেন রুশ সেনারা। অপর দিকে ১২ হাজারের বেশি রুশ সেনাকে হত্যার দাবি করেছে ইউক্রেন। তাদের ভাষ্যমতে, যুদ্ধে রাশিয়ার ৩৭৪টি ট্যাংক, ১ হাজার ২২৬টি সামরিক যান এবং ১৪০টি আর্টিলারি সিস্টেম ধ্বংস হয়েছে।

আরেক মেয়রকে ধরে নেওয়ার অভিযোগ

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মেলিতোপোলে নতুন একজন মেয়র দিয়েছে রুশ বাহিনী। গতকাল এ খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এ অঞ্চলের আরেক শহর নিপরোরুদনের মেয়র ইয়েভহেন মাতভেয়েভকে ধরে নেওয়ার অভিযোগ করেছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ।
ইউক্রেনে হামলা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে মেলিতোপোলের নিয়ন্ত্রণ নেন রুশ সেনারা। তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হচ্ছিলেন না ওই শহরের মেয়র ইভান ফেদেরোভ। গত শুক্রবার তাঁকে চোখ বেঁধে ধরে নেওয়ার ভিডিও প্রকাশিত হয়। শনিবার রাতে স্থানীয় টেলিভিশনে শহরের সাবেক কাউন্সিলর গালিনা দানিলচেঙ্কোকে নতুন মেয়র ঘোষণা করা হয়। তিনি নগরবাসীর প্রতি ‘উগ্রপন্থী কর্মকাণ্ডে’ অংশ না নেওয়ার আহ্বান জানান।