১২ বছর বনে নেকড়ের সনে

ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রাডইয়ার্ড কিপলিংয়ের বিখ্যাত চরিত্র মোগলির কথা মনে আছে আপনাদের? ভারতের মধ্যাঞ্চলের গভীর বনে বাঘের আক্রমণে ব্রিটিশ মা-বাবার মৃত্যুর পর একটি নেকড়ে পরিবারের সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেছিল যে শিশুটি?
মানবসন্তানের সঙ্গে বনের জীব-জন্তুদের ভালোবাসার এ গল্প অনেকের মনে নাড়া দিয়েছিল। গল্পটি লেখকের নিছক কল্পনা হলেও বাস্তব পৃথিবীর অনেক গল্প মাঝেমধ্যে কল্পনাকেও হার মানায়।
সম্প্রতি বিবিসি ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে এমনই এক গল্প প্রকাশিত হয়েছে। গল্পটি সত্যিকারের এক মোগলির। অবিশ্বাস্য সেই ব্যক্তিটি হলেন স্পেনের ষাটোর্ধ্ব মারকোস রদ্রিগেজ প্যানতোহা। নিতান্ত শিশু বয়সে গভীর বনে গিয়ে নেকড়ে, সাপ ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গী বনে যান তিনি। কাটিয়ে দেন প্রায় এক যুগ।
মারকোসের জবানিতে জানা গেছে, তাঁর বয়স তখন ছয় কি সাত। একদিন অর্থকষ্টের কাছে নতিস্বীকার করে এক কৃষকের কাছে মারকোসকে বিক্রি করে দিলেন তাঁর দরিদ্র বাবা। ওই কৃষক তাঁকে সিয়েরা মোরেনা পাহাড়ে নিয়ে যান। মারকোসের কাজ ছিল ওই কৃষকের সঙ্গে তাঁর ছাগলের পাল চরানো। তবে বিধি বাম, কিছুদিন পর ওই বৃদ্ধ কৃষক মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর পাহাড়ের গভীর অরণ্যে পালিয়ে যান মারকোস।
রাখালের কাজ করতে গিয়ে এরই মধ্যে মারকোস শিখে গেছেন কীভাবে ফাঁদ পেতে খরগোশ বা তিতির পাখি ধরতে হয়। তাই বনে থাকার দিনগুলোতে খাবারের অভাব হয়নি তাঁর। জনমানবশূন্য বনে নিঃসঙ্গ মারকোসের সঙ্গে দ্রুত পশুপাখির অদ্ভুত সখ্য গড়ে ওঠে।
একদিনের ঘটনা, একটি গুহার ভেতর কিছু নেকড়ে ছানার সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠেন মারকোস। খেলতে খেলতে গুহার ভেতর ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। খানিক পর বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে গুহায় প্রবেশ করে নেকড়ে মা। ঘুম ভাঙার পর মারকোস দেখেন, নেকড়ে মা হিংস্র দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে। নেকড়ে শাবকগুলো মহা আনন্দে মাংসের টুকরো খাচ্ছিল। ক্ষুধার্ত মারকোস পাশে থাকা একটি নেকড়ে শিশুর খাবার চুরি করার চেষ্টা করলে মা নেকড়ে থাবা দিয়ে মারকোসকে সরিয়ে দেয়। শিশুদের খাওয়া শেষ হলে মা নেকড়ে মারকোসের দিকে এক টুকরো মাংস ছুড়ে দেয়। প্রথমে মারকোস ভয়ে তা স্পর্শ করেননি। তা দেখতে পেয়ে নেকড়ে মা নাক দিয়ে মাংসের টুকরোটি আবারও তাঁর দিকে ঠেলে দেয়। মারকোস সভয়ে মাংসের টুকরোটি তুলে নিয়ে খেতে শুরু করেন। এ সময় নেকড়ে মা তার জিহ্বা দিয়ে মারকোসকে আদর করে দেয়। এভাবে মারকোস ওই নেকড়ে পরিবারটির একজন হয়ে ওঠেন।
নেকড়ে পরিবারটি ছাড়াও একটি সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে কিশোর মারকোসের। গুহার ভেতর ওই সাপটির সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছিলেন মারকোস।
এ ব্যাপারে মারকোস বলেন, ‘আমি সাপটির জন্য একটি বাসা তৈরি করি। তাকে ছাগলের দুধ পান করাতাম। এভাবে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। আমি যেখানে যেতাম, সেও আমার পিছু পিছু যেত। সে আমাকে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করত।’
১৯৬৫ সালে ১৯ বছর বয়সী মারকোসকে সিয়েরা মোরেনার গভীর অরণ্য থেকে উদ্ধার করে স্পেনের পুলিশ।
উদ্ধারের পর মারকোসের পরিচয় নিশ্চিত করতে পুলিশ তাঁর বাবাকে সামনে নিয়ে আসে। দেখা হওয়ার পর বাবা তাঁকে প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিলেন, ‘তোমার জ্যাকেটটি কোথায়?’
মারকোস বলেন, ‘বাবার ভাবটা এমন ছিল, যেন এত দিন ধরে আমি জ্যাকেটটা পরে ছিলাম।’ বাবাকে দেখে তাই কোনো অনুভূতি হয়নি তাঁর।
মানবসমাজে ফিরে আসার দিনটিকে তাঁর জীবনের সবচেয়ে ‘ভয়ানক মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন মারকোস। তাঁর জন্য প্রতিটি অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। নাপিতের দোকানে চুল কাটতে নিয়ে যাওয়া হলে মারকোস ভেবেছিলেন, নাপিত বেটা বুঝি তাঁর আস্ত গলাটাই কেটে দেবে।
প্রথম যেদিন খাবার টেবিলে বসিয়ে এক বাটি স্যুপ তাঁর সামনে রাখা হলো, তখন এর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন মারকোস। কিছু বুঝতে না পেরে বাটিটির ভেতর যেই হাত চোবালেন তিনি, অমনি উত্তপ্ত স্যুপের তাপে তার হাত ঝলসে যায়। মুহূর্তে বাটিটি হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মাদ্রিদে এক নান তাঁকে বিছানায় ঘুমানোর বিষয়টি শেখাতে চাইলে তাঁর সঙ্গে রীতিমতো কুস্তি লেগে যায়।
দীর্ঘদিন বনে থাকার কারণে মানবসমাজের রীতিনীতি, সভ্যতা-ভব্যতা শিখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে মারকোসকে। শুরুর দিকে রাস্তা পার হতে খুব ভয় পেতেন মারকোস। চারপাশের শব্দ, মানুষের হট্টগোলের সঙ্গে আজও অভ্যস্ত হতে পারেননি তিনি। সোজা হয়ে হাঁটতে শেখানোর জন্য মারকোসের পিঠে কাঠের টুকরো বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
ধীরে ধীরে এসব শিখে নিয়েছেন মারকোস। স্পেনের রানতে অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রামে ১৫ বছর ধরে বাস করছেন তিনি। সেখানকার বাসিন্দারা তাঁকে খুব পছন্দ করেন। বিগত বছরগুলোতে পিয়ানো ও গিটার বাজাতে শিখেছেন মারকোস। গ্রামের একটি ছোট্ট বারে এগুলো বাজিয়ে মাঝেমধ্যে গ্রামবাসীদের আনন্দ দেন।
সিয়েরা মোরেনার সেই বনে কি আবারও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে—এমন প্রশ্নের জবাবে মারকোস বলেন, এ বিষয়ে আমি অনেকবারই ভেবেছি। তবে এখনকার জীবনে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখানকার অনেক জিনিস ওই বনে পাব না। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংগীত ও নারী। মারকোস জানান, তাঁর বেশ কয়েকজন বান্ধবী ছিল। আপাতত তিনি নিঃসঙ্গ দিন কাটাচ্ছেন।