বিশ্বের দিকে দিকে সামরিক উত্তেজনা বাড়ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলা এবং সর্বশেষ ভারত-পাকিস্তান সংঘাত দেখেছে বিশ্ব। যুদ্ধক্ষেত্রের ‘রাজা’খ্যাত সামরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে ট্যাংক বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে ট্যাংকের উপস্থিতি একটি দেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। সর্বশেষ রাশিয়ার ইউক্রেনে হামলার প্রথম দিকে ট্যাংকের দীর্ঘবহর দেখেছে বিশ্ব।
বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা নিয়ে কাজ করা গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার মনে করে, ট্যাংকবহরের আকার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কোনো দেশের সামরিক কৌশল ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে প্রতিফলিত করে। নিচে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের ট্যাংকবহরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো—
বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ট্যাংক আছে চীনের। গত কয়েক বছরে দেশটি নিজেদের ট্যাংকবহর দ্রুত বাড়িয়েছে। পাশাপাশি ব্যাপক আধুনিকায়ন করেছে। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ৬ হাজার ৮০০। তাদের বহরে ‘টাইপ ৯৯’ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ‘টাইপ ৯৯এ’ মডেলের ট্যাংক রয়েছে।
ট্যাংকগুলোতে ১২৫ মিমি কামান, উন্নত ফায়ার কন্ট্রোল, স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন, থার্মাল ইমেজিং ও সক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। তবে টাইপ ৯৯এ এখন পর্যন্ত রাশিয়ার তৃতীয় প্রজন্মের টি-১৪ আর্মাতা বা দক্ষিণ কোরিয়ার কে২ ব্ল্যাক প্যানথারের সমকক্ষ নয়।
রাশিয়ার ট্যাংকবহর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তাদের বহরে টি-৭২, টি-৮০, টি-৯০ এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির টি-১৪ আর্মাতা মডেলের ট্যাংক রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে দেশটির ট্যাংকের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৫৫৬টি। ইউক্রেন যুদ্ধে দেশটি বিপুলসংখ্যক ট্যাংক হারিয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ার বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ৫ হাজার ৭৫০টি। বর্তমানে দেশটি প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ৫০০ ট্যাংক উৎপাদন করছে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্মিলিত উৎপাদনের চেয়ে তিন গুণ বেশি। রাশিয়ার ট্যাংকগুলো দ্রুতগতি, শক্তিশালী কামান ও উন্নত প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য বিখ্যাত। টি-১৪ অটোমেটেড টারেট, ক্রু সুরক্ষা ক্যাপসুল ও আধুনিক সেন্সর রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংকবহর বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী যুদ্ধযানগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটির প্রধান ট্যাংকের নাম এম১ আব্রামস, যা ১৯৮০ সাল থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ট্যাংকের আধুনিক সংস্করণগুলো হলো এম১এ১, এম১এ২ এবং এম১এ২ সেপ। এতে রয়েছে উন্নত কামান, থার্মাল ইমেজিং, ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম ও শক্তিশালী বর্ম রয়েছে। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৪০টি। ইরাক, আফগানিস্তান ও উপসাগরীয় যুদ্ধে এম১ আব্রামস ব্যবহার করা হয়েছিল।
উত্তর কোরিয়ার ট্যাংকবহর সংখ্যায় বিশাল, কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে। বর্তমানে তাদের বহরে ৪ হাজার ৩৪৪টি ট্যাংক রয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি টি৩৪/৮৫, টি৫৫ এবং চীনের টাইপ-৫৯ মডেলের ট্যাংক ব্যবহার করে দেশটি। পাশাপাশি নিজেদের নকশা করা চনমা-হো, পোকপুঙ-হো এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চিওনমা-২ মডেলের ট্যাংকও রয়েছে দেশটির। উত্তর কোরিয়ার প্রকৃত ট্যাংক সংখ্যা কত, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। ধারণা করা হয়, বর্তমানে দেশটির ৪ হাজার ৩৪৪টি ট্যাংক রয়েছে।
ভারতের প্রধান ট্যাংক হলো অর্জুন। নিজেদের তৈরি এই ট্যাংক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির। এতে ডিজিটাল ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম, ১২৫ মিমি স্মুথবোর কামান, উন্নত বর্ম ও অ্যাকটিভ প্রটেকশন সিস্টেম রয়েছে। মডেলটির সর্বশেষ সংস্করণের নাম এমকে-২। এ ছাড়া দেশটি সোভিয়েত আমলের তৈরি টি-৯০ ও টি-৭২ মডেলের ট্যাংকও ব্যবহার করে। তাদের বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ৪ হাজার ২০১টি।
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম১এ১ আব্রামস মিসরের প্রধান ট্যাংক। এ ছাড়া সোভিয়েত আমলের তৈরি টি-৫৫ ও টি-৬২ মডেলের ট্যাংকও ব্যবহার করে দেশটি। দেশটির ট্যাংকের সংখ্যা ৩ হাজার ৬২০। মিসরের ট্যাংকবহর মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম বৃহৎ। ট্যাংকবহর আধুনিকীকরণে মনোযোগ বাড়িয়েছে দেশটি।
পাকিস্তানের প্রধান ট্যাংকগুলো হলো আল-খালিদ, আল-জারার, টি-৮০ইউডি, টি-৫৯। চীনের সহায়তায় তৈরি আল-খালিদে ১২৫ মিমি কামান, উন্নত ফায়ার কন্ট্রোল ও স্বয়ংক্রিয় লোডার রয়েছে। টি-৮০ইউডি রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত দ্রুতগামী ট্যাংক। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ২ হাজার ৬২৭টি।
তুরস্কের ট্যাংকবহরে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম৬০ প্যাটন, জার্মানির লেপার্ড১ ও লেপার্ড২ এবং নিজেদের তৈরি আলতাই রয়েছে। নিজেদের নকশা করা আলতাই ট্যাংক ১২০ মিমি স্মুথবোর কামান, উন্নত বর্ম, থার্মাল সেন্সর এবং ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে। লেপার্ড২ অত্যাধুনিক সুরক্ষা ও নির্ভুল আক্রমণক্ষমতা দিয়ে সজ্জিত। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ২ হাজার ২৩৮। ন্যাটোর সদস্যদেশটি ট্যাংকের আধুনিকায়ন অব্যাহত রেখেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান ট্যাংক কে২ ব্ল্যাক প্যানথার। নিজেদের তৈরি এই ট্যাংকে প্রায় সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তারা ট্যাংক তৈরিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। ব্ল্যাক প্যানথার বিশ্বের অন্যতম সেরা ও ব্যয়বহুল ট্যাংক হিসেবে পরিচিত। এটি পোল্যান্ডসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়েছে। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ২ হাজার ২৩৬টি।
ইরানের ট্যাংকবহর বৈচিত্র্যময় এবং দেশীয়ভাবে তৈরি ও বিদেশি ট্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত। দেশটির প্রধান ট্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত রাশিয়ার তৈরি টি-৭২, টি-৫৫ ও টি-৬২। নিজেদের তৈরি ট্যাংক হলো জুলফিকার ও কারার।
জুলফিকার ট্যাংকে ১২৫ মিমি কামান, উন্নত ফায়ার কন্ট্রোল এবং শক্তিশালী বর্ম রয়েছে। কারার আরও আধুনিক। এতে সক্রিয় প্রতিরক্ষা ও থার্মাল সেন্সর রয়েছে। দেশটির বর্তমান ট্যাংকের সংখ্যা ১ হাজার ৭১৩। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি নিজেদের প্রযুক্তিতে ট্যাংক উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছে এবং সামরিক স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করছে।