বিশ্বের নিরাপদ শীর্ষ ১০ দেশ ও অঞ্চলের ৮টিই এশিয়ায়

জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো দেশের সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তাই বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিপুল অর্থ ব্যয় ও মনোযোগ দিয়ে থাকে। কিন্তু বিশ্বের নিরাপদ দেশ ও অঞ্চলের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত এবং গণতান্ত্রিক দেশগুলোর অবস্থান নিচের দিকে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য নিয়ে করা ‘নামবিও সেফটি ইনডেক্স ২০২৫’-এর (নামবিও নিরাপত্তাসূচক) জরিপে এমনটিই উঠে এসেছে।

সার্বিয়াভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবামূলক প্ল্যাটফর্মটি সম্প্রতি একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ২০২৫ সালে বিশ্বে নিরাপত্তার দিক থেকে যে ১০টি দেশ ও অঞ্চল শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছে, তার ৮টিই এশিয়ায়। বাকি দুটি ইউরোপে।

১৪৮টি দেশ ও স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত অঞ্চল নিয়ে করা জরিপটিতে ৩৮ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৬তম। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারত ৫৫ দশমিক ৮ স্কোর নিয়ে ৬৭তম, আরও ৪৮ দশমিক ৪ স্কোর নিয়ে ৯৯তম স্থানে রয়েছে মিয়ানমার।

এ ছাড়া ৫০ দশমিক ৮ স্কোর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৯১তম, ৫১ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে যুক্তরাজ্য ৮৬তম, ৭৬ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে চীন ১২তম, ৬১ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে রাশিয়া ৫২তম, ১৯ দশমিক শূন্য স্কোর নিয়ে ১৪৮তম তথা সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতি।

নাগরিকের মধ্যে অপরাধের আশঙ্কা, রাতের নিরাপত্তা, পুলিশের ওপর আস্থা, শারীরিক সহিংসতার ভয়, গাড়ি চুরি বা ছিনতাই এবং বর্ণবাদ বা বৈষম্যের শিকার হওয়ার শঙ্কাসহ নানা সূচকের ভিত্তিতে স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে। জরিপের জন্য ক্রাউডসোর্সিংয়ের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ক্রাউডসোর্সিং হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ইন্টারনেট বা উন্মুক্ত মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য বা মতামত চাওয়া হয়।

নামবিও সেফটি ইনডেক্স ২০২৫-এর বিশ্বের শীর্ষ ১০ নিরাপদ দেশ ও অঞ্চল নিয়ে নিচে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো।

সংযুক্ত আরব আমিরাত

বিশ্বের নিরাপদ দেশের তালিকায় নামবিও সেফটি ইনডেক্সে শীর্ষে উঠে এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত
ছবি: রয়টার্স

৮৫ দশমিক ২ স্কোর নিয়ে বিশ্বের নিরাপদ দেশের তালিকায় নামবিও সেফটি ইনডেক্স ২০২৫-এ শীর্ষে উঠে এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। কঠোর আইন ও উন্নত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কারণে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটিতে অপরাধ বেশ কম। দেশটির পুলিশ ২৪ ঘণ্টা বেশ তৎপর থাকে। নাগরিক ও বাসিন্দাদের চোখে চোখে রাখতে ব্যবহার করা হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। বিদেশি নাগরিক ও পর্যটকদের রাত ও দিনে উচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তবে এতটা নজরদারি ব্যবস্থার ব্যবহারের কারণে দেশটির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনাও রয়েছে।

অ্যান্ডোরা

স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী স্থলবেষ্টিত দেশটিতে অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায়
ছবি: এএফপি

ইউরোপের অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ অ্যান্ডোরা ৮৪ দশমিক ৮ স্কোর নিয়ে রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী স্থলবেষ্টিত দেশটিতে অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

৪৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে এটি বিশ্বের ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম দেশ। জনসংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। দেশটির আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন। প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি পর্যটক অ্যান্ডোরায় আসেন। স্কি রিসোর্ট ও শুল্কমুক্ত কেনাকাটার জন্য বিখ্যাত।

কাতার

ঘন জনসংখ্যা সত্ত্বেও কাতারে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, রাতের নিরাপত্তা ও পুলিশি সেবা বেশ সক্রিয়
ছবি: রয়টার্স

পারস্য উপসাগরীয় বা মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কাতার রয়েছে তৃতীয় স্থানে। দেশটির স্কোর ৮৪ দশমিক ৬। জ্বালানি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ দেশটির আয়তন মাত্র ১১ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার। ঘন জনসংখ্যা সত্ত্বেও অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, রাতের নিরাপত্তা ও পুলিশি সেবা বেশ সক্রিয়। আন্তর্জাতিক পর্যটন ও খেলাধুলা আয়োজনে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে দেশটি কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে।

তাইওয়ান

তাইওয়ানের তাইপে চিয়াং শাক-কাই মেমোরিয়াল হলে পতাকা উত্তোলন করছেন দুই নিরাপত্তাকর্মী
ফাইল ছবি: রয়টার্স

তাইওয়ান ৮৩ দশমিক শূন্য স্কোর নিয়ে রয়েছে চতুর্থ স্থানে। নাগরিক নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক সম্পর্কের কারণে স্বশাসিত অঞ্চলটিতে অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলটিতে রাতেও মানুষ নিশ্চিন্তে ঘোরাঘুরি করতে পারেন, যা নাগরিক নিরাপত্তার প্রতি আস্থা বাড়িয়েছে।

ম্যাকাও

চীনের স্বায়ত্তশাসিত ম্যাকাওয়ের মনোরম একটি দৃশ্য
ছবি: রয়টার্স

৮১ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ম্যাকাও। এটি চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, যা বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল (এসএআর) হিসেবে পরিচিত। তবে তাদের নিজস্ব আইন, বিচারব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। এখানে সহিংস অপরাধের হার অত্যন্ত কম, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটখাটো চুরি বা জালিয়াতির মতো অপরাধ ছাড়া বড় ধরনের অপরাধ বিরল।

বিশ্বের অন্যতম বড় ক্যাসিনোকেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ম্যাকাওয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর ও সংগঠিত। ক্যাসিনো ও পর্যটন অঞ্চলে সর্বক্ষণ সিসিটিভি নজরদারি ও পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি থাকে।

ওমান

ওমানের পুরোনো মাসকট শহরের একটি দৃশ্য
ফাইল ছবি: রয়টার্স

চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিশ্বের নিরাপদ দেশের নামবিও সেফটি ইনডেক্সে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ওমান। দেশটির স্কোর ৮১ দশমিক ৪। দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রয়্যাল ওমান পুলিশ (আরওপি) ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা (আইএসএস) সক্রিয়ভাবে কাজ করে।

দেশটির শহরাঞ্চলে সিসিটিভি ও ডিজিটাল নজরদারির ব্যবহার অত্যন্ত ব্যাপক। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনায়ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। সরকারি কঠোর নজরদারি নিয়ে বিতর্কও আছে।

আইল অব ম্যান

আইল অব ম্যানের সরকারি প্রতীক
অফিসিয়াল সাইট থেকে নেওয়া

স্বায়ত্তশাসিত দ্বীপরাষ্ট্র আইল অব ম্যান ৭৯ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে রয়েছে সপ্তম স্থানে। উত্তর ইংল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের মধ্যবর্তী আইরিশ সাগরে অবস্থিত অঞ্চলটি যুক্তরাজ্যের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তাদের নিজস্ব দক্ষ পুলিশ বাহিনী ও নজরদারি ব্যবস্থা রয়েছে। প্রায় ৮৪ হাজার ১১৬ জনের অঞ্চলটির অপরাধের হার অত্যন্ত কম এবং সহিংসতা প্রায় অনুপস্থিত।

হংকং

পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হংকং শহরের মনোরম একটি দৃশ্য
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উন্নত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য সুপরিচিত হংকং। ৭৮ দশমিক ৫ স্কোর নিয়ে চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটির অবস্থান অষ্টম। শহরে পুলিশের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত নজরদারির কারণে অপরাধের হার কম। হংকং সরকারের আধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা, ডেটা বিশ্লেষণ ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্য ও পর্যটককেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হংকংয়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনাও অবশ্য রয়েছে।

আর্মেনিয়া

আর্মেনিয়া পাহাড়ি দেশ হলেও সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেশ কঠোর
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ককেশাস তথা ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে (ইউরোএশিয়া) অবস্থিত পাহাড়ি দেশ আর্মেনিয়া ৭৭ দশমিক ৬ স্কোর নিয়ে বিশ্বের নিরাপদ দেশের মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে। দেশটির দক্ষ পুলিশ বাহিনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

জনসাধারণের মধ্যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আস্থা যথেষ্ট সন্তোষজনক। অপরাধ দমনে সিসিটিভি ক্যামেরা ও ডিজিটাল নজরদারির মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।

১০

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরের মার্লিয়ন পার্ক পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

নামবিও সেফটি ইনডেক্সে ৭৭ দশমিক ৪ স্কোর নিয়ে বিশ্বের নিরাপদ দেশগুলোর মধ্যে ১০ নম্বর অবস্থানে রয়েছে নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়।

বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রটিতে অপরাধ প্রতিরোধে অত্যাধুনিক নজরদারি সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি সামাজিক নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।