সারা বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে মহামারির কথা উঠলে প্রথমেই করোনাভাইরাসের নাম আসবে। ২০২০ সালে এই মহামারির প্রাদুর্ভাবে সারা বিশ্বে প্রাণ গেছে ৭০ লাখের বেশি মানুষের। তবে এর ১০০ বছর আগেও এ ধরনের একটি মহামারি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। যার নাম দেওয়া হয়েছিল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু। যে মহামারিতে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মহামারি বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কখনো এত মানুষের মৃত্যু হয়নি।
মহামারির শুরু
সময়টা তখন ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে আসার পথে। যুদ্ধ শেষে সৈন্যরা যাঁর যাঁর দেশে প্রিয়জনদের কাছে মাত্রই ফিরতে শুরু করেছেন। ঠিক এমন সময় তাঁদের বাড়িতে অপেক্ষা করছিল নীরব এক ঘাতক। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’।
করোনার সঙ্গে বোধ হয় এই মহামারির অনেকটা মিল আছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ মাসে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়েছিল। এর ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রথম রোগী শনাক্ত হয়। ১৯১৯ সাল পর্যন্ত রোগটির দাপট ছিল।
স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম খবর আসে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প থেকে। প্রথম দিকে এটি মৌসুমি জ্বর, সর্দি ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা দেখা দিয়েছিল।
এই মহামারিকে তিনটি ধাপে ভাগ করা হয়। প্রথম ধাপে দ্রুতই এটি পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাই মাসে পোলাল্ডে রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম দিকে অনেকেই এটিকে সাধারণ সর্দি–কাশি মনে করছিলেন। তা ছাড়া এর প্রভাবও তেমন একটা দেখা যায়নি।
তবে দ্বিতীয় ধাপে এই ভাইরাস প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে শুরু করে। আগস্ট নাগাদ অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে পুরো ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভাইরাসটি। প্রথম দিকে রোগীর নিউমোনিয়া শনাক্ত হতো। এর দুই–তিন দিনের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হতো।
এরপরের ধাপটি ছিল শীতকালে। শীত মৌসুমের পর বসন্তকালে এটি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকেন।
স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের কারণ
এই মহামারির নাম স্প্যানিশ ফ্লু কেন হলো, স্বভাবতই সেই প্রশ্ন আসতে পারে। মহামারির সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এতে অংশ নেয়। তারা তখন যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক এমন সময় মহামারি শুরু হওয়ায় প্রথম দিকে এসব দেশ ভাইরাসটির দিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি।
অপর দিকে ইউরোপের আরেক দেশ স্পেন তখন বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়নি। মহামারি শুরুর পর দেশটির সংবাদপত্রগুলো তাই এই রোগ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করে। তাদের মাধ্যমেই সারা বিশ্বের নজরে আসে নতুন এই রোগ।
এ নিয়ে লন্ডনের কুইন ম্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়েলকাম ট্রাস্টের একজন গবেষক মার্ক হনিগসবাউম ১৯১৮ সালে এই মহামারি নিয়ে একটি বই লেখেন। যার নাম ‘লিভিং উইথ এঞ্জা’।
এই মহামারির নাম স্প্যানিশ ফ্লু কেন হলো, স্বভাবতই সেই প্রশ্ন আসতে পারে। মহামারির সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এতে অংশ নেয়।
মার্ক হনিগসবাউম বলেন, স্পেনের সংবাদমাধ্যমগুলো এই রোগের খবর প্রকাশ করছিল। এটাই স্প্যানিশ ফ্লু নামকরণের পেছনের কারণ। মহামারি শুরু হলে স্পেনের রাজপরিবার এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির অসুস্থ হওয়ার খবর দেশটির সংবাদমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করেছিল। কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশে এ ধরনের সংবাদ তেমন গুরুত্ব পায়নি। তাই স্পেনের নামানুসারেই রোগটির নামকরণ হয়েছিল।
ফ্লু কখন ছড়াল
স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম খবর আসে ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প থেকে। প্রথম দিকে মৌসুমি জ্বর, সর্দি ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা দিয়েছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের সংবাদপত্রগুলো মহামারি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে তেমন একটা আগ্রহ দেখায়নি। ফলস্বরূপ এসব দেশের সৈন্যরা এক দেশ থেকে আরেক দেশের ময়দান দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন মহামারির জীবাণুও।
এই মহামারি নিয়ে লেখা ‘প্যানডেমিক ১৯১৮’ বইয়ের লেখক ক্যাথারিন আর্নল্ড লিখেছেন, যুদ্ধের সময় বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েনের ফলে ফ্লু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা জাহাজে করে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গেলে ভারত, আফ্রিকা ও রাশিয়ার মতো দূরবর্তী বন্দরেও ছড়িয়ে পড়ে মহামারি।
কারা আক্রান্ত হতেন
স্প্যানিশ ফ্লুতে বিভিন্ন বয়সী মানুষ আক্রান্ত হতে থাকেন। সাধারণত শিশু ও প্রবীণদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ছিল। সুস্থ সবল তরুণদের মধ্যে এর মাত্রা ছিল মাঝারি। শেষের দিকে ভাইরাসটি দ্রুত বিস্তার করতে থাকে। আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল এই ভাইরাস।
১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার কোনো চিকিৎসা ছিল না এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগের চিকিৎসায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকও আবিষ্কার হয়নি। সে সময় দ্রুত পরিপূর্ণ হয়ে যেত হাসপাতালগুলো।
ওই সময় সংক্রমণ ঠেকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ধরনের লকডাউন জারি করা হয়নি। তবে অনেক থিয়েটার, নাচের হল, সিনেমা হল এবং গির্জা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিছু কিছু শহরে জীবাণুনাশক দেওয়া হয়। অনেকে দেশেই সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরতে দেখা যেত।
সেপ্টেম্বরে প্রাণঘাতী ধাক্কা
স্প্যানিশ ফ্লুর দ্বিতীয় এবং আরও বেশি প্রাণঘাতী ধাক্কাটি আসে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে। সে সময় কেপটাউন হাসপাতালের প্রধান নার্স লন্ডন টাইমসের কাছে লেখা এক চিঠিতে তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন।
এই নার্স চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘দুই সপ্তাহে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হলো।
কেপটাউনকে মনে হচ্ছিল মৃত্যুনগরী। রাস্তা থেকে মৃতদেহ তুলে নেওয়ার জন্য কাভার্ড ভ্যান সারা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দোকানপাট বন্ধ। ট্রেন ও ট্রাম চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। মৃতদেহ সৎকার করার জন্য কোনো যাজক কিংবা গির্জার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
মহামারি যেভাবে শেষ
১৯১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ ফ্লু-মুক্ত হয়ে যায়। ১৯১৯ সালের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়।
তবে ওই বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মহামারির তৃতীয় ঢেউ নিউইয়র্কে পৌঁছায়। যুদ্ধ বন্ধের শান্তি আলোচনা চলাকালে মহামারিতে প্যারিস বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষের দিকে খুব কম মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন।
১৯১৯ সালের মে মাসে যুক্তরাজ্যের হ্যাম্পশায়ারকে মহামারি মুক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে ওই বছরের শেষের দিকে জাপানে আবারও মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর পাঁচ কোটির বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে ১৯২০ সালের শেষের দিকে এই মহামারি উধাও হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র:
যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি), বিবিসি, এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, সায়েন্স ফ্রাইডে