শক্তিশালী ১০ ভূমিকম্পের দুটিই আঘাত হানে রাশিয়ায়, আজকেরটি কততম

রাশিয়ার পূর্ব উপকূল ও আশপাশের এলাকা স্থানীয় সময় আজ বুধবার সকালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে। সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক সময় যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানিও ছাড়িয়ে যায়। ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা দেওয়ার মতো কার্যকর প্রযুক্তি এখনো মানুষের হাতে নেই।

ভূমিকম্প কতটা শক্তিশালী ছিল, তা মাপা হয় রিখটার স্কেলে। সেই হিসাবে রাশিয়ার আজকের ভূমিকম্প ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ১০ ভূমিকম্পের একটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, ৮ দশমিক ৮ মাত্রার এই ভূমিকম্প সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের তালিকায় ৬ নম্বরে স্থান পেয়েছে। এর আগে ২০১০ সালে চিলির বায়োবিও অঞ্চলে এবং ১৯০৬ সালে ইকুয়েডরের এসমেরালদাসে একই মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ১০ ভূমিকম্প কবে ও কোথায় হয়েছে, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক—

ভালদিভিয়া ভূমিকম্প (১৯৬০)

ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে চিলির ভালদিভিয়া শহরে এমন বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছিল
ছবি: এএফপি

ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ‘গ্রেট চিলিয়ান ভূমিকম্প’ নামেও পরিচিত। ১৯৬০ সালের ২২ মে বিকেলে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলির ভালদিভিয়া শহরে আঘাত হানে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। এর তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ৫। ভূমিকম্পের পর সুনামি আছড়ে পড়ে চিলির উপকূলে। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের অন্যপাশে হাওয়াই উপকূল, জাপান ও ফিলিপাইনের উপকূলীয় এলাকায় সুনামি আঘাত হেনেছিল।

ভালদিভিয়া ভূমিকম্পে প্রায় ১ হাজার ৬৫৫ জন প্রাণ হারান। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা কমবেশি দেখানো হয়। ওই ভূমিকম্পে প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিলেন।

গ্রেট আলাস্কা ভূমিকম্প (১৯৬৪)

১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ শুক্রবার বিকেলে দক্ষিণ-মধ্য আলাস্কায় আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে এভাবেই সড়কে বিশাল ফাটল দেখা দিয়েছিল
ছবি: ইউএসজিএসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া স্ক্রিনশট

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় আঘাত হানা এ ভূমিকম্পকে ‘গুড ফ্রাইডে ভূমিকম্প’ নামেও ডাকা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৭ মার্চ গুড ফ্রাইডের বিকেলে আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ড অঞ্চলে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ২। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প এটি।

ভূমিকম্পের পর ২৭ ফুট উঁচু সুনামি উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। এ ভূমিকম্প ও সুনামিতে ১৩৯ জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। তাঁদের মধ্যে শুধু ভূমিকম্পে মারা যান ১৫ জন। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার।

জাপানের উপকূলঘেঁষা প্রশান্ত মহাসাগরে ২০১১ সালের ১১ মার্চ আঘাত হানে শক্তিশালী এক ভূমিকম্প। রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ১। এই দুর্যোগে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জাপানে ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

সুমাত্রা ভূমিকম্প (২০০৪)

ভূমিকম্প ও সুনামির ধ্বংসস্তূপের সামনে বসে আছেন এক ব্যক্তি। ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহ
ফাইল ছবি: এএফপি

আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগ এটি। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে এ ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ১। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের কাছে। তাই এটিকে সুমাত্রা ভূমিকম্প নামে ডাকা হয়।

ভূমিকম্পের পর উপকূলীয় এলাকায় ১০০ ফুট উঁচু সুনামি আছড়ে পড়ে। এটা ভারত মহাসাগরীয় সুনামি, দক্ষিণ এশীয় সুনামি, ইন্দোনেশীয় সুনামি, ক্রিসমাস সুনামি—এমন নানা নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্প ও সুনামিতে ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান, গৃহহীন হন প্রায় ১১ লাখ মানুষ। দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ভূমিকম্প এবং সুনামির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

তোহোকু ভূমিকম্প (২০১১)

সুনামিতে ফুলেফেঁপে সাগরের পানি লোকালয়ে ঢুকছে। ১১ মার্চ ২০১১, জাপানের মিয়াগি প্রদেশের নাতোরি শহরে
ছবি: রয়টার্স

জাপানের উপকূলঘেঁষা প্রশান্ত মহাসাগরে ২০১১ সালের ১১ মার্চ আঘাত হানে ‘গ্রেট তোহোকু’ নামের এক ভূমিকম্প। তীব্রতা ছিল ৯ দশমিক ১। ভূমিকম্পের পর প্রলয়ংকরী সুনামি জাপানে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল ১৩৩ ফুট উঁচু। এমনকি জাপানের উপকূল থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরেও সুনামির ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকে পড়ে।

ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী দুর্যোগ বিবেচনা করা হয় এটাকে। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ জাপান সরকার জানায়, ভূমিকম্প ও সুনামিতে ১৫ হাজার ৮৯৪ জন নিহত ও ৬ হাজার ১৫২ জন আহত হয়েছিলেন। নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা ২ হাজার ৫৬২, গৃহহীন ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। এ দুর্যোগে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ জাপানে ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল সুমাত্রা ভূমিকম্প। এ ভূমিকম্পের পর উপকূলীয় এলাকায় ১০০ ফুট উঁচু সুনামি আছড়ে পড়ে। ভূমিকম্প ও সুনামিতে ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান।

কামচাতকা ভূমিকম্প (১৯৫২)

১৯৫২ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়ার দূর পূর্বাঞ্চলের কামচাতকা উপদ্বীপে আঘাত হেনেছিল এ ভূমিকম্প। এর তীব্রতা ছিল ৯। এটি বিশ্বে রেকর্ডকৃত প্রথম ভূমিকম্প, যার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৯–এর ঘরে পৌঁছেছিল।

ভূমিকম্পের পর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে উঠে আসা সুনামি উপকূলীয় অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল। ৫০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনপদ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় কামচাতকা উপদ্বীপ ও কুরিল দ্বীপে। ভূমিকম্প আর সুনামিতে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার মানুষ নিহত হন, ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ডলারের বেশি।

রাশিয়ার পূর্ব উপকূলীয় ভূমিকম্প (২০২৫)

১৯৫২ সালের মতো আজকের ভূমিকম্পেও রাশিয়ার কামচাতকা উপদ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভূমিকম্পে সেখানকার একটি কিন্ডারগার্টেনের ছাদ ধসে পড়ে। ৩০ জুলাই ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

রাশিয়ার দূর পূর্ব উপকূলে আজ ৩০ জুলাই সকালে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। ইউএসজিএস বলেছে, এটির কেন্দ্রস্থল ছিল রাশিয়ার পেত্রোপাভলোভস্ক-কামচাতস্কি শহর থেকে ১৩৬ কিলোমিটার বা প্রায় ৮৫ মাইল পূর্বে, প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। রাশিয়ার উপকূলে এ শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর জাপানের আবহাওয়া সংস্থা সুনামি সতর্কতা জারি করে।

একই মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আমেরিকার চিলির উপকূলে আঘাত হেনেছিল। ভূমিকম্পের পর সুনামিতে দেশটির উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় তালচাউয়ানো বন্দর। ভূমিকম্প ও সুনামিতে নিহত হন ৫২৫ জন। নিখোঁজ ছিলেন আরও অন্তত ২৫ জন।

ইকুয়েডর-কলম্বিয়া ভূমিকম্প (১৯০৬)

দক্ষিণ আমেরিকার দুই দেশ ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ায় ১৯০৬ সালের ৩১ জানুয়ারি আঘাত হানে ভূমিকম্প। মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। ভূমিকম্পের পর শক্তিশালী সুনামি হয়।

ভূমিকম্প ও সুনামিতে দুই দেশেই ব্যাপক অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছিল। ভূমিকম্প ও সুনামিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আহত ও বাস্তুচ্যুত হন আরও অনেকে।

র‍্যাট আইল্যান্ডস ভূমিকম্প (১৯৬৫)

যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা অঙ্গরাজ্যের র‍্যাট আইল্যান্ডসে ১৯৬৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আঘাত হানে শক্তিশালী এই ভূমিকম্প। এর তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭। ওই অঞ্চলে জনবসতি খুবই সীমিত। সেই কারণে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পরও হতাহতের ঘটনা ছিল নগণ্য।

তবে ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি আলাস্কা পেরিয়ে হাওয়াই ও ক্যালিফোর্নিয়ায় আঘাত হেনেছিল, কোথাও কোথাও ৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল।

আসাম-তিব্বত ভূমিকম্প (১৯৫০)

১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসাম-তিব্বতে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ভারতের আসাম ও পার্শ্ববর্তী তিব্বতে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট। তিব্বতের সীমান্তঘেঁষা রিমা অঞ্চল ছিল ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৬। এ ভূমিকম্পে ওই অঞ্চলে দেড় থেকে তিন হাজার মানুষ নিহত হন। বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভূমিকম্পের কারণে ভূমিধসে স্থানীয় সোবনশিরি নদীর গতিপথ আটকে যায়। আট দিন পর ভেঙে পড়ে সেখানকার বাঁধ। প্লাবিত হয় অসংখ্য গ্রাম। এতে নিহত হন ৫৩৬ জন। এ ভূমিকম্পের কারণে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।

১০

ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প (২০১২)

২০১২ সালের ১১ এপ্রিল সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের বান্দা আচেহ শহরে একটি হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

ইন্দোনেশিয়ার আচেহ শহরসংলগ্ন ভারত মহাসাগরে ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল আঘাত হেনেছিল শক্তিশালী ভূমিকম্প। তীব্রতা ছিল ৮ দশমিক ৬। এটা ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ভূমিকম্পের পরপর সুনামি সতর্কতা জারি করা হলেও কিছু সময় পর তা তুলে নেওয়া হয়।

এই ভূমিকম্পে ১০ জন নিহত ও ১২ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ মারা যান আতঙ্কে কিংবা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে।