অন্য রকম এক বন্ধুত্বের কাহিনি

সমাজবাদী পার্টির (এসপি) প্রধান অখিলেশ যাদব সারস ও মোহাম্মদ আরিফকে দেখতে সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের আমেথিতে যান
ছবি: এএনআই

এ এক আজব বন্ধুত্বের কাহিনি। মানুষ ও সারসের। যা ভারতের পশু–প্রাণী প্রেমীদের মতো সর্বস্তরের মানুষের মন উথালপাতাল করে তুলেছে। দাবি উঠেছে, অনুনয়–অনুরোধও, বিচ্ছেদ ঘুচিয়ে দুই বন্ধুর মিলন ঘটানোর। কী করবেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ? কিংবা আইনের রক্ষকেরা?

কাহিনির সূত্রপাত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আমেথি জেলার মান্ডকা গ্রামের তরুণ কৃষক মোহাম্মদ আরিফ (৩০) বাড়ির কাছে আহত সারসটিকে দেখতে পান। তার পা ভেঙে গিয়েছিল। উড়তে পারছিল না। সারসটিকে তিনি বাড়ি নিয়ে যান। শুরু করেন শুশ্রূষা। ধীরে ধীরে সারসটি সেরে ওঠে। তারপর আরিফ একদিন তাকে মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, বন্ধুতার বন্ধন কতখানি দৃঢ়। সারসটি আরিফের বাড়িতেই ফিরে আসে। বন্ধুকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।

সেই শুরু। আজব এই বন্ধুত্বের কাহিনি তত দিনে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম ছেড়ে জেলা, জেলার সীমানা পেরিয়ে রাজ্যে। আরিফ যেখানেই যান, উড়তে উড়তে চলে বন্ধু সারস। দূর দূর এলাকার লোকজন আসতে থাকে মান্ডকা গ্রামে দুই বন্ধুকে দেখতে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেই কাহিনি। বিপদ হয়ে ওঠে ওটাই। ওই প্রচার। টনক নড়ে আইনের রক্ষকদের। শুরু হয় বন্ধু–বিচ্ছেদের করুণ বিয়োগান্ত পর্ব।

বন বিভাগের লোকজন হাজির হন আরিফের বাড়ি। অভিযোগ, সারসটিকে ‘বন্দী’ করে আরিফ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ভেঙেছেন। আইন ভাঙার অপরাধে আরিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে সারসটিকে ‘উদ্ধার’ করে নিয়ে যাওয়া হয়। তার জায়গা হয় কানপুর চিড়িয়াখানার খাঁচায়। আইন অনুযায়ী ১৫ দিনের নিভৃতাবাস। তারপর আইন মেনেই বন্য প্রাণীকে ছেড়ে দিতে হবে বনে।

সেখান থেকেই কাহিনির আরও এক বাঁকের শুরু। বিপত্তিরও। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের নজরে পড়ে, বন্ধু বিচ্ছেদে কাতর সারস মনমরা। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সব সময় যেন অন্য কিছুর প্রতীক্ষা। মনমরা হয়ে পড়েন আরিফও। বিচ্ছেদের এই কাহিনিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমের দৌলতে। একের পর এক আবেদন যেতে থাকে রাজ্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ দপ্তরের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের কাছেও। প্রত্যেকের আবেদন, বিচ্ছেদ ঘুচিয়ে দুই বন্ধুর পুনর্মিলন ঘটানো হোক।

এই অবস্থায় সারসকে বাঁচাতে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ আরিফের কাছে যান। তাঁকে নিয়ে আসেন কানপুর চিড়িয়াখানায়। মনমরা সারস বন্ধুকে দেখে সতেজ হয়ে ওঠে। গোটা আকাশ যার ভুবন, চিড়িয়াখানার ছোট্ট পরিসরে বন্ধুকে দেখে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। আরিফ অভুক্ত বন্ধুকে খাইয়ে দেন।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তোলা সেই ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। নতুন করে বয়ে যায় অনুরোধের বন্যা। রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার সূর্য প্রতাপ সিং মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথকে সেই ভিডিও পাঠিয়ে লেখেন, ‘আজ এই প্রথমবার আপনার কাছে কিছু চাইছি। মুক্তি দিন সারসটিকে। এই দুজনের বন্ধুত্ব আইনের চেয়ে বড়। কী লাভ এদের আলাদা করে?’

একই দাবি রাজ্যের বিরোধী নেতা অখিলেশ যাদবেরও। আরিফ ও সারসের কাছে তিনিও গিয়েছিলেন। ছবি দিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমে। যদিও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে বলেছেন, বন বিভাগের আচরণ প্রমাণ করে, বিজেপি অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।

টুইট করেছেন বিজেপি নেতা ও সাংসদ বরুণ গান্ধীও। আরিফকে দেখে কানপুর চিড়িয়াখানায় সারসের ছটফটানির ভিডিও জুড়ে তিনি লিখেছেন, ‘সারস ও আরিফের কাহিনি সত্য। এদের প্রেম নির্মল। এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রাণীটির জন্ম ওড়ার জন্য, খাঁচায় বন্দী জীবন কাটানোর জন্য নয়। ওর আকাশ, স্বাধীনতা ও বন্ধুকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’

কী করবে রাজ্য সরকার? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করছে এই কাহিনির পরের পর্ব।