‘মানবতার কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান’ মন্ত্র সামনে রেখে ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। শুরুতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি—এই পাঁচ ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হতো। অর্থনীতির পুরস্কারটি যোগ হয় ১৯৬৯ সালে।
সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামে ও তাঁর রেখে যাওয়া অর্থে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। আলফ্রেড নোবেল সুইডিশ শিল্পপতি ও ডিনামাইটের উদ্ভাবক ছিলেন। ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেল মারা যান। নোবেল বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে তাই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নোবেল পুরস্কার জয়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১০ দেশ নিয়ে আজকের আয়োজন।
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে পশ্চিমা দেশগুলোর আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। এর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণার সুযোগ, ভাষাগত আধিপত্যসহ নানা কারণ কাজ করছে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার গেছে যুক্তরাষ্ট্রে, ৪২৩টি। মার্কিনরা সবচেয়ে বেশি ১০৯ বার চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এর পর যথাক্রমে পদার্থবিদ্যায় ১০০ বার, রসায়নে ৮৬ বার, অর্থনীতিতে ৬৯ বার, শান্তিতে ২৮ বার ও সাহিত্যে ১৫টি নোবেল পুরস্কার গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে।
যুক্তরাষ্ট্রের চারজন সাবেক প্রেসিডেন্ট শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। তাঁদের মধ্যে থিওডোর রুজভেল্ট ১৯০৬ সালে, উড্রো উইলসন ১৯১৯ সালে, জিমি কার্টার ২০০২ সালে ও বারাক ওবামা ২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।
যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার গেছে যুক্তরাজ্যে, ১৪৩টি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে অবদানের জন্য যুক্তরাজ্যের নাগরিকেরা সবচেয়ে বেশি ৩৬টি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। এর পরেই আছে রসায়ন।
যুক্তরাজ্যের হয়ে প্রথম নোবেল পুরস্কার জেতেন বিজ্ঞানী স্যার উইলিয়াম রামসে। তিনি হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপ্টন, জেননসহ নোবেল গ্যাসের একটি সম্পূর্ণ পরিবার আবিষ্কার করেন। নোবেল গ্যাস হলো একধরনের রাসায়নিক মৌল, যা খুব কম বিক্রিয়াশীল।
এ ছাড়া পদার্থবিদ্যায় ২৮টি, শান্তিতে ১৪টি, অর্থনীতিতে ১০টি ও সাহিত্যে ৮টি নোবেল পুরস্কার গেছে যুক্তরাজ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পর সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার জয়ের তালিকায় ৩ নম্বরে আছে জার্মানি। এখন পর্যন্ত ১১৫টি নোবেল পুরস্কার গেছে জার্মানিতে। জার্মানরা সবচেয়ে বেশি ২৯টি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন রসায়নে। এরপর যথাক্রমে ২৪টি পদার্থবিদ্যায়, ১৭টি চিকিৎসাশাস্ত্রে, ৮টি সাহিত্যে, শান্তিতে ৫টি ও ১টি অর্থনীতিতে।
নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন জগদ্বিখ্যাত আলবার্ট আইনস্টাইন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্যে আলোক তড়িৎ ক্রিয়া ব্যাখ্যার তত্ত্ব দেওয়ার জন্য আইনস্টাইন ১৯২১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় অসামান্য অবদান রাখা আইনস্টাইনের বিখ্যাত ইকুয়েশন (E=mc2) ও থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জে করে বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের জানাকে পাল্টে দিয়েছে।
শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার স্বর্গভূমি বলা হয় ফ্রান্সকে। এখন পর্যন্ত ৭৬টি নোবেল পুরস্কার গেছে ফ্রান্সে। এর মধ্যে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার ১৬টি।
ফ্রান্সে সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার গেছে পদার্থবিদ্যা বিভাগ থেকে, ১৭টি। এ ছাড়া রসায়নে ১০টি, চিকিৎসাশাস্ত্রে ১১টি, শান্তিতে ৯টি ও অর্থনীতিতে ৩টি নোবেল জিতেছেন ফ্রান্সের নাগরিকেরা।
প্রথম নারী হিসেবে নোবেল পুরস্কার জয় করেন ফরাসি বিজ্ঞানী মেরি কুরি। মেরি কুরির জন্ম পোল্যান্ডে, পরে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণায় মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়েরে কুরি অসামান্য অবদান রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য পিয়েরে কুরির সঙ্গে ১৯০৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জেতেন মেরি কুরি। শুধু তা-ই নয়, মেরি কুরি একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন।
সুইডেনের স্টকহোমের নোবেল ফাউন্ডেশন থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত ৩৪টি নোবেল পুরস্কার সুইডেনে রয়ে গেছে। সাহিত্য ও চিকিৎসাশাস্ত্রে আটটি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সুইডেনের নাগরিকেরা। এরপর যথাক্রমে রসায়নে পাঁচটি, শান্তিতে পাঁচটি, পদার্থবিদ্যায় চারটি ও অর্থনীতিতে দুটি নোবেল পুরস্কার।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচে বেশি নোবেল পুরস্কার গেছে জাপানে। এখন পর্যন্ত জাপানের নাগরিকেরা ৩১টি নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কার গেছে পদার্থবিদ্যায়। এরপর যথাক্রমে রসায়নে সাতটি, চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঁচটি এবং সাহিত্য ও শান্তিতে দুটি করে নোবেল পুরস্কার জাপানে গেছে।
গত বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতে জাপানের পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন নিহন হিদানকায়ো। পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি বিশ্ব গড়ার পক্ষে সংগঠনটি কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের একমাত্র দেশ জাপান, যেখানে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়েছিল।
সোভিয়েত-পূর্ব রুশ সাম্রাজ্য যুগে রুশ বিজ্ঞানচর্চার বিকাশকালীন ১৯০৪ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার জেতেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইভান পাভলোভ। এখন পর্যন্ত মোট ৩০টি নোবেল পুরস্কার গেছে রাশিয়ায়। এর মধ্যে পদার্থবিদ্যায় ১১টি, রসায়নে ৩টি, সাহিত্যে ৬টি, চিকিৎসাশাস্ত্রে ২টি, শান্তিতে ৫টি ও অর্থনীতিতে ৩টি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে কম বয়সী নোবেল বিজয়ী কানাডার ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং। ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সালে চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান তিনি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। এখন পর্যন্ত ২৮টি নোবেল গেছে কানাডায়। এর মধ্যে সাতটি পদার্থবিদ্যায়, সাতটি রসায়নে, দুটি সাহিত্যে, ছয়টি চিকিৎসাশাস্ত্রে, দুটি শান্তিতে, সাহিত্যে দুটি ও অর্থনীতিতে চারটি নোবেল জয় করেছেন কানাডার নাগরিকেরা।
২৭টি নোবেল পুরস্কার নিয়ে সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কারজয়ী দেশের তালিকায় ৯ নম্বরে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। পদার্থবিদ্যায় আটটি, রসায়নে সাতটি, সাহিত্যে দুটি, চিকিৎসাশাস্ত্রে সাতটি ও শান্তিতে তিনটি নোবেল পুরস্কার সুইজারল্যান্ডে গেছে।
২৫টি নোবেল পুরস্কার নিয়ে সবচেয়ে বেশি নোবেল পুরস্কারজয়ী দেশের তালিকায় ১০ নম্বরে রয়েছে অস্ট্রিয়া। পদার্থবিদ্যায় আটটি, রসায়নে ছয়টি, সাহিত্যে তিনটি, চিকিৎসাশাস্ত্রে পাঁচটি, শান্তিতে দুটি ও অর্থনীতিতে একটি নোবেল পুরস্কার অস্ট্রিয়া গেছে।
তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ