হীরার খনিগুলো যেন প্রকৃতির গোপন ভান্ডার। গভীর ভূগর্ভে আগ্নেয়শিলা কিম্বারলাইটের মধ্যে এই মহামূল্যবান রত্ন থাকে। কিম্বারলাইটের অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে এই হীরা পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি উঠে আসে। হীরার খনির অবস্থান শনাক্ত করে সেখানে উত্তোলনের কাজ চলে।
বিশ্বজুড়ে হীরা উত্তোলনের জন্য প্রধানত দুটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। ওপেন-পিট বা উন্মুক্ত খনি এবং আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং বা ভূগর্ভস্থ খনি। ২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি হীরার খনি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস। এতে বলা হয়, বিশ্বে মোট উত্তোলিত হীরার প্রায় ৫০ শতাংশ শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। মাত্র ২০ শতাংশ হীরা রত্নমানের, যা অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি হীরার খনির ৫টিরই অবস্থান রাশিয়ায়। ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি হীরার খনি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
রাশিয়ার সাখা অঞ্চলে আইখাল খনির অবস্থান। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরার খনি। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এই খনিতে মজুতের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ কোটি ৫৫ লাখ ৬০ হাজার ক্যারেট। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এটি ওপেন-পিট বা উন্মুক্ত খনি ছিল। এরপর এটিকে ভূগর্ভস্থ খনিতে রূপান্তর করা হয়।
আইখাল হীরার খনি থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৩ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়। বিশ্বের অপরিশোধিত হীরার এক-তৃতীয়াংশ এখান থেকেই উত্তোলন করা হয়ে থাকে। রাশিয়ার আংশিক রাষ্ট্রায়ত্ত হীরা কোম্পানি আলরোসার অধীনস্থ আইখাল মাইনিং কোম্পানি এই খনি পরিচালনা করে।
বতসোয়ানার কালাহারি মরুভূমিতে জোয়ানেং খনির অবস্থান। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হীরার খনি। ডি বিয়ার্স ও বতসোয়ানা সরকারের যৌথ উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত ডেবসওয়ানা ডায়মন্ড কোম্পানি খনিটি পরিচালনা করে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুসারে, এ খনিতে হীরার সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ১৬ কোটি ৬৬ লাখ ক্যারেট। বর্তমানে খনিটির ৪০০ মিটার গভীরে খননকাজ চলছে। ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এ খনি থেকে হীরা উত্তোলন করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
উদাচনি খনির অবস্থান রাশিয়ার ইয়াকুতিয়া অঞ্চলের সাখা রিপাবলিকে। রুশ ভাষায় ‘উদাচনি’র অর্থ ‘ভাগ্যবান’। আলরোসা কোম্পানি এ খনি পরিচালনা করে।
১৯৭১ সালে এ খনিতে হীরা উত্তোলন শুরু হয়। তখন এটি উন্মুক্ত খনি ছিল। বর্তমানে, খনিটি থেকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে হীরা উত্তোলন করা হয়। এ খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ১৬ কোটি ৪৪ লাখ ৬০ হাজার ক্যারেট।
জুবিলি খনির অবস্থানও রাশিয়ার ইয়াকুতিয়া অঞ্চলের সাখা রিপাবলিকে। এটি উন্মুক্ত পদ্ধতির হীরার খনি। ২০১৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাব অনুসারে এই খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি ৩০ লাখ ক্যারেট। এর মধ্যে ৫ কোটি ১০ লাখ ক্যারেট হীরা ভূগর্ভে মজুত আছে।
১৯৮৬ সাল থেকে এটি আলরোসার আইখাল মাইনিং ও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হীরা কোম্পানি আলরোসার প্রসেসিং ডিভিশনের যৌথ মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। ২০২২ সালে এ খনি থেকে প্রায় ৪৯ লাখ ৯০ হাজার ক্যারেট হীরা উত্তোলন হয়।
নিউরবা খনি রাশিয়ার সাখা অঞ্চলে অবস্থিত। এটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম হীরার খনি। এ খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হীরা উত্তোলন করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসের হিসাব অনুসারে এ খনিতে মজুতের পরিমাণ ১৩ কোটি ৩০ লাখ ক্যারেট।
বতসোয়ানার ফ্রান্সিসটাউন থেকে ২৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্ট এলাকায় ওরাপা খনির অবস্থান। ডি বিয়ার্স ও বতসোয়ানা সরকারের যৌথ মালিকানার কোম্পানি ডেবসওয়ানা এ খনি পরিচালনা করে থাকে। ১৯৭১ সাল থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এখান থেকে হীরা উত্তোলন করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের হিসাব অনুসারে এ খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি ১২ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে ওরাপা খনি থেকে প্রায় ৮ কোটি ৮৫ লাখ ক্যারেট হীরা উত্তোলন করা হয়েছে।
কাটোকা হীরার খনি অ্যাঙ্গোলার লুন্ডা সুল প্রদেশে অবস্থিত। ১৯৯৩ সাল থেকে এই খনিতে হীরা উত্তোলনের কাজ চলছে। অ্যাঙ্গোলার মোট উত্তোলন করা হীরার প্রায় ৭৫ শতাংশ এ খনি থেকে উত্তোলন করা হয়। খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি ক্যারেট।
একাটি খনি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম হীরার খনি। কানাডার নর্থ–ওয়েস্ট টেরিটরিজ অঞ্চলে এর অবস্থান। এটি কানাডার প্রথম উন্মুক্ত ও ভূগর্ভস্থ হীরার খনি। ১৯৯৮ সাল থেকে এ খনিতে হীরা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়।
২০১৭ সালের জানুয়ারি নাগাদ এই খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৫৪ লাখ ক্যারেট। খনিতে যে পরিমাণ মজুত আছে, তাতে ধারণা করা হয়, ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এখানে হীরা উত্তোলনের কাজ চলবে। বারগান্ডি ডায়মন্ড মাইনস কোম্পানি খনিটি পরিচালনা করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার লিম্পোপো প্রদেশে ভেনেটিয়া খনির অবস্থান। এটি বিশ্বের নবম বৃহত্তম খনি। এখানে উন্মুক্ত ও ভূগর্ভস্থ দুই পদ্ধতিতেই হীরা উত্তোলন হয়।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুসারে এই খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ প্রায় ৯ কোটি ২৪ লাখ ক্যারেট। ডি বিয়ার্স কোম্পানি খনিটি পরিচালনা করে। খনিতে যে পরিমাণ মজুত আছে, তাতে ২০৪৬ সাল পর্যন্ত হীরা উত্তোলন চলবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মির খনির অবস্থান রাশিয়ার সাখা অঞ্চলে। এটি ‘মিরনি’ নামেও পরিচিত। এর অর্থ ‘শান্তি’। ১৯৫৫ সালে খনিটি আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৫৭ সালে এখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হীরা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। ২০১১ সাল পর্যন্ত সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদনের কাজ চলেছে।
২০১১ সালে এটি ভূগর্ভস্থ পদ্ধতির হীরার খনিতে রূপান্তরিত হয়। এ খনিতে সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৭৭ লাখ ৭০ হাজার ক্যারেট। ২০১৭ সালের আগস্টে একটি দুর্ঘটনার পর খনির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। আলরোসা নিরাপত্তা মূল্যায়ন ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির পর খনির কার্যক্রম নতুন করে শুরুর পরিকল্পনা করছে।