ইতিহাসজুড়ে আমরা বিভিন্ন সাম্রাজ্য দেখতে পাই, যারা নিজেদের মূল আঞ্চলিক সীমানার বাইরে গিয়েও তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে। অনেক সাম্রাজ্য তাদের এ লক্ষ্যে দারুণ সফল হয়েছে। যদিও কালের বিবর্তনে প্রবল পরাক্রমশালী এসব সাম্রাজ্যের সূর্য একসময় অস্তমিত হয়েছে, উত্থান ঘটেছে নতুন আরেক সাম্রাজ্যের। ইতিহাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা এসব সাম্রাজ্যের কোনো কোনোটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থেকেছে, কোনো কোনোটি বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে নিজেদের পদচিহ্ন এঁকেছে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ১০ সাম্রাজ্য নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।
বিশ্ব ও বিশ্বের ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। যে কেউ ভাষা থেকে সংস্কৃতি বা আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ জীবনের অনেক ক্ষেত্রে আজও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাব দেখতে পাবেন। নানা সভ্যতা, যুদ্ধ ও বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে কয়েক শতাব্দী ধরে এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছে ১৯ শতকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য যখন মধ্যগগনে, তখন ১ কোটি ৩৭ লাখ ১০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল, যা পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের এক–চতুর্থাংশ।
জনসংখ্যা ও ভূমি উভয় দিক দিয়ে এটি ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য ছিল। তাই লোকেরা বলতেন, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য কখনো অস্তমিত হয় না’। কারণ, সারা বিশ্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশ ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দ্রুত ক্ষয় হতে শুরু করে। যুক্তরাজ্য তাদের বেশির ভাগ উপনিবেশের দখল হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়। তবে বিশ্বেজুড়ে এখনো নানা ক্ষেত্রে এ সাম্রাজ্যের স্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর অন্যতম মঙ্গল সাম্রাজ্য। ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে ৯২ লাখ ৭০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। সবচেয়ে বেশি উত্থান হয় ১২০৬ থেকে ১৩৬৮ সালের মধ্যে। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে সব মঙ্গল জাতিগোষ্ঠীকে একজোট করার মধ্য দিয়ে মঙ্গল সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়। অর্ধশতাব্দীর মধ্যে পূর্ব ইউরোপের বেশির ভাগ অংশ এবং মধ্য এশিয়া ও চীনের অধিকাংশ অঞ্চল মঙ্গল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে।
ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এই সাম্রাজ্যের সূর্য মধ্যগগনে ছিল। মঙ্গল রাজারা বিপুল পরাক্রমের সঙ্গে একের পর এক যুদ্ধে জিতে দ্রুত নিজেদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তবে মঙ্গল সাম্রাজ্য কেবল নৃশংস যুদ্ধকৌশলের জন্যই নয়, বরং বিভিন্ন সংস্কৃতিকে একত্র করার এবং নিজেদের রাজত্বে বাণিজ্য সম্প্রসারণে সাফল্যের জন্যও স্বীকৃত।
১৭২১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশজুড়ে রাজনীতিতে রুশ সাম্রাজ্যের দারুণ প্রভাব ছিল। ১৮৯৫ সালে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৮৮ লাখ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এই সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। সে সময় বড় ইউরোপীয় শক্তির অন্যতম ছিল রুশ সাম্রাজ্য। নেপোলিয়নের ইউরোপ দখল রুখতে এ সাম্রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
দারুণ সব সামরিক অভিযানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছে চিং সাম্রাজ্য। তাদের অভিযানের ফলে চীনের ভূখণ্ডের বিস্তার ঘটেছে। সম্রাট চিনলংয়ের আমলে, ১৭৫০ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত চীনের সীমান্ত ৫৬ লাখ ৮০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল। যার মধ্যে তিব্বত, হাইনান, তাইওয়ান এবং ইনার এশিয়ার একটি বড় অংশ ছিল। ওই সব অঞ্চল আগে স্বাধীন অথবা বিদেশি শক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল।
চিং সাম্রাজ্যের শুরুতে এর অধীনে থাকা অঞ্চলগুলো স্থিতিশীল ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সেখানে কৃষি ও বাণিজ্য খাতের সম্প্রসারণও দ্রুত হয়েছিল। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে একসময় কৃষিজমি কমতে শুরু করে, বেকারত্ব বাড়তে থাকে এবং দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ে। চীনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে চিং সাম্রাজ্য।
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের অন্যতম স্প্যানিশ সাম্রাজ্য। পর্তুগাল ও স্পেন মিলে যখন ইউরোপের আবিষ্কার যুগের নেতৃত্ব দিচ্ছে, সে সময় এই সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয় এবং দ্রুত বিশ্বের বড় শক্তিতে পরিণত হয়। প্রায় পাঁচ শতাব্দী এই সাম্রাজ্য টিকে ছিল।
স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ বিস্তার ঘটেছিল ১৭ শতকের শেষ ভাগে। সে সময় ৫২ লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটেছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল এবং পৃথিবীর আরও বেশ কয়েকটি অঞ্চলে স্প্যানিশ উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। বৈশ্বিক বাণিজ্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে এই সাম্রাজ্য গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
প্রথম ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সাফল্যের হাত ধরে ১৯ শতকের প্রথম থেকে মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের যাত্রা শুরু হয়। যুক্তরাজ্যের মতো ফ্রান্সও একসময় সারা বিশ্বে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তুলেছিল। ফ্রান্স সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ গড়েছিল আফ্রিকায়।
আমেরিকা, ক্যারিবীয় ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও ছোট ছোট কয়েকটি ফরাসি উপনিবেশ ছিল। এই সাম্রাজ্যের প্রভাব যখন চূড়ায়, সে সময় ৪৪ লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এর বিস্তার ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিতীয় ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল হয় স্বাধীন হয়ে যায় অথবা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়।
ইসলামি খিলাফতের মধ্যে তৃতীয় আব্বাসীয় খিলাফত। অষ্টম শতকের মধ্যভাগে উমাইয়া খিলাফতকে উৎখাত করে আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিষ্ঠা হয়। আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনামলে ইসলামের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়। এই খিলাফত যখন চূড়ায়, তখন পূর্ব দিক দিয়ে ভারতের পশ্চিম সীমান্ত থেকে উত্তর আফ্রিকা উপকূল পর্যন্ত (বর্তমানে আলজেরিয়ার পশ্চিম দিক) ৪২ লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এর বিস্তার ছিল।
৬৬১ থেকে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উমাইয়া খিলাফত যখন মধ্যগগনে, সে সময় মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ অঞ্চল থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত ৪২ লাখ ৯০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এই খিলাফতের বিস্তার ঘটেছিল। ইতিহাসের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যগুলোর একটি এটি। সে সময় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৯ শতাংশ উমাইয়া খিলাফতের অধীন ছিল।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শেষের দিকে বিশাল মঙ্গল সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ায় চীনের শাসনে ইউয়ান রাজবংশের আবির্ভাব ঘটে। মঙ্গল সাম্রাজ্যের পঞ্চম খাগান রাজা কুবলাই খানের হাত ধরে ইউয়ান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। তিনি সম্রাট শিজু নামেও পরিচিত ছিলেন।
১২৭১ থেকে ১৩৬৮ সাল পর্যন্ত এই রাজবংশ টিকে ছিল। ক্ষমতার চূড়ায় থাকাকালে বর্তমান চীনের প্রায় পুরোটাই ইউয়ান রাজত্বের অংশ ছিল। সঙ্গে মঙ্গলিয়া, কোরীয় উপদ্বীপসহ এই রাজত্ব ৪২ লাখ ৫০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল।
একটি প্রাচীন আদিবাসী সংঘ, জিঅংনু রাজত্ব। আদিবাসী নেতা মডু চানিউ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে জিঅংনু সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। ৩৪ লাখ ৭০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে এ রাজত্বের বিস্তার ঘটেছিল।