সিরিয়ায় চ্যালেঞ্জ ত্রাণ পৌঁছানো, তুরস্কে লুটপাট ঠেকানো

ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে কিশোরী কিউডিকে। গতকাল সিরিয়ার হাতায়ে
ছবি: এএফপি

তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত শহরগুলোতে বাড়ছে লাশের সারি। ইতিমধ্যে দেশ দুটিতে নিহতের সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার ছয় দিন পরেও গতকাল বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নজিরবিহীন দুর্যোগে যখন মানুষ দিশাহারা, সে সময়ে তুরস্কের শহরে লুটপাটের ঘটনাও ঘটছে। এদিকে এখনো সিরিয়ার সব অঞ্চলে দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ নিয়ে যেতে পারেনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

তুরস্কের ইতিহাসে ১৯৩৯ সালের পর এবারের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। এই ভূমিকম্পে শুধু তুরস্কে এখন পর্যন্ত সাড়ে ২৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছেন বহু মানুষ। জাতিসংঘের আশঙ্কা, ভূমিকম্পে দুই দেশে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

দুর্যোগে বিপর্যস্ত তুরস্কের সহায়তায় বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ এগিয়ে এলেও এখনো দেশটিতে দুর্গত মানুষকে আশ্রয় ও তাঁদের কাছে খাবার পৌঁছে দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। এর মধ্যে গোষ্ঠীগত সংঘাত ও লুটপাট সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

শনিবার তুরস্কে উদ্ধারকাজ স্থগিতের ঘোষণা দেয় জার্মানির দুটি সংস্থা। কারণ হিসেবে তারা একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষের কথা জানায়। স্থানীয় লোকজনও লুটপাটের কথা জানিয়েছেন। হাতায় প্রদেশের আন্তাকিয়া শহরে উদ্ধারকাজে যোগ দিতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ সানলিউরফা থেকে এসেছিলেন গিজেম নামের এক ব্যক্তি। তিনি লুটপাটকারীদের দেখেছেন বলে জানান। গিজেম বলেন, ‘আমরা তাঁদেরকে সেভাবে ঠেকাতে পারিনি, লুটপাটকারীদের অধিকাংশের হাতেই ছিল ছুরি।’

ভূম্পিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় শহর কাহরামানমারাস শহরের এক বাসিন্দা বলেন, তাঁর ঘরে থাকা সব অলংকার চুরি হয়ে গেছে। এখানকার বাস্তুহারা বাসিন্দারা বলছেন, নিজেদের বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির যত দূর সম্ভব কাছেই তাঁরা তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করছেন। লুটপাট ঠেকাতেই তাঁরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এই পরিস্থিতিতে বন্দরনগরী ইসকেনদেরুনের মুঠোফোন ও অলংকারের দোকানের নিরাপত্তায় বাণিজ্যিক সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। লুটপাটকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

গতকাল সিএনএন তুর্ক টেলিভিশন জানিয়েছে, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় হাতায় প্রদেশে বিধ্বস্ত একটি ভবন থেকে ভূমিকম্পের ১৪৯ ঘণ্টার পর একজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মুস্তফা নামে ৩৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন রোমানিয়া থেকে আসা উদ্ধারকারী দল। একজন উদ্ধারকর্মী বলেন, ‘তাঁর স্বাস্থ্য ভালো আছে, উদ্ধারের সময় তিনি কথা বলছিলেন।’

তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে ভূমিকম্প–পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে সমালোচনা চলছে। সমালোচকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, উদ্ধারকাজে কেন দ্রুততার সঙ্গে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। তারা ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভূমিকম্পে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ত্রাণ সরবরাহ বিঘ্নিতসহ কিছু সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বিরোধীদের প্রতি ‘নেতিবাচক’ রাজনীতি ছেড়ে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ভবন নির্মাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ভূপ্রাকৃতিক কারণে তুরস্ক ভূমিকম্পপ্রবণ। এ বিষয়ে আগে সতর্কও করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এরপরও দেশটিতে গত বছর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার সুউচ্চ ভবনগুলোও ধসে পড়েছে। এতে বহুতল এসব ভবন নির্মাণে আইন মানা হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় জানিয়েছেন, কয়েকটি ভবন ধসে পড়ার ঘটনায় সেগুলো নির্মাণে জড়িত এমন ১৩১ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রায় ছয় হাজার ভবন ধসে পড়েছে।

ভবন নির্মাণে আইন লঙ্ঘনকারীদের বিচার নিশ্চিতের অঙ্গীকার করে তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘প্রয়োজনীয় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বিষয়টির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখব। বিশেষ করে যেসব ভবন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যেগুলোতে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’

সিরিয়ায় এখনো ত্রাণ যেতে বাধা

ভূমিকম্পে সিরিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল। সেখানকার বহু মানুষ দ্বিতীয়বারের মতো গৃহহীন হয়েছেন। দেশটিতে প্রায় এক যুগ ধরে চলা গৃহযুদ্ধের কারণে এর আগেও তাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। এরপরও সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের তুলনায় তাঁরা সামান্যই ত্রাণসহায়তা পেয়েছেন।

জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণসহায়তা প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস এক টুইটে বলেছেন, ‘আমরা এখনো উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারিনি।’ তিনি বলেন, ওই এলাকার বাসিন্দারা ঠিকই নিজেদের অবহেলিত ভাবছেন। বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা দরকার।

জাতিসংঘের একজন মুখপাত্র বলেছেন, অনুমোদন না দেওয়ায় সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে কট্টরপন্থী বিরোধী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহের কাজ ঝুলে আছে। এ অঞ্চলের বেশির ভাগের নিয়ন্ত্রণ করছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী।

ইদলিবে এইচটিএসের একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে কোনো ধরনের ত্রাণবাহী বহর ঢুকতে দেবে না তাঁরা। উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ আসবে তুরস্ক থেকে। তিনি বলেন, ‘তুরস্ক সব সড়ক খুলে দিয়েছে। পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে সহায়তা করছে—এমনটি দেখানোর সুযোগ সিরিয়া সরকারকে আমরা দেব না।’