ঠিক ৩৬ বছর আগে আজকের এই দিনে (৪ জুন) বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে কী ঘটেছিল, কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, সেসবের সঠিক হিসাব আজও অজানা। তবে সেদিনের একটি মুহূর্তের ছবি বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল, কীভাবে সাহসে ভর করে একা রুখে দাঁড়িয়ে শাসকের অস্ত্র থামিয়ে দেওয়া যায়।
১৯৮৯ সাল। তিয়েনআনমেনে বিক্ষোভকারীদের ওপর চীনের সামরিক বাহিনীর চড়াও হওয়ার পরদিন ৫ জুন কয়েকটি ছবি বিশ্ববাসীর সামনে আসে। ছবিগুলোতে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা একজনকে সড়কের চলন্ত ট্যাংকবহরের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর দুই হাতে দুটি শপিং ব্যাগ ধরা, যেন সবে বাজার করে বাড়ি ফিরছেন। ছবিতে থাকা ওই ব্যক্তির পরিচয় আজও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সারা বিশ্ব তাঁকে ‘ট্যাংকম্যান’ নামে মনে রেখেছে।
কয়েকজন আলোকচিত্রী তিয়েনআনমেন স্কয়ারের কাছে সেদিনের সেই মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে পেরেছিলেন। তাঁদের একজন জেফ উইডনার। তিনি বেইজিং হোটেলের কক্ষ থেকে ছবিটি তুলেছিলেন। আরেক আলোকচিত্রী স্টুয়ার্ট ফ্রাঙ্কলিনের তোলা ‘ট্যাংকম্যান’ ছবি টাইম সাময়িকীতে ছাপা হয়। তিনি ছবি তুলেছিলেন বেইজিং হোটেলের ব্যালকনি থেকে।
৫ জুন পশ্চিমা আরও কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ট্যাংকম্যানের ছবি ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। পরে এক সাক্ষাৎকারে স্টুয়ার্ট ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘এ ছবির মধ্য দিয়ে লোকটির অসাধারণ সাহস ফুটে উঠেছে। সমাজে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে যেন তৈরি ছিলেন তিনি।’
কর্তৃত্ববাদী শাসকের অপ্রতিরোধ্য শক্তির বিরুদ্ধে শুধু ব্যক্তিগত সাহসে ভর করে রুখে দাঁড়াবার প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির সামনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাথানত করতে বাধ্য হয়েছিল শাসকের দুর্নিবার অস্ত্র। এরপর তাঁর কী হয়েছিল, জানা যায়নি। কেউ কেউ তাঁকে ‘ওয়াং উইলিন’ বলে সন্দেহ করলেও চূড়ান্তভাবে কেউ তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি।
এদিকে আলোকচিত্রী চার্লি কোল তিয়েনআনমেনে তাঁর তোলা ‘ট্যাংকম্যান’ ছবির জন্য ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্য ইয়ার পুরস্কার-১৯৮৯ পেয়েছিলেন।
ইতিহাসের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছবির ছোট্ট তালিকা করা হলেও সেখানে নিশ্চিতভাবেই জায়গা করে নেবে ‘ট্যাংকম্যান’। এ ছবির পটভূমি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে অতীতে, ১৯৮৯ সালে, যখন চীন বিক্ষোভে উত্তাল।
দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে রাজধানী বেইজিংয়ে টানা বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভের মূলকেন্দ্র ছিল শহরের তিয়েনআনমেন স্কয়ার। ১৯৮৯ সালের ৪ জুন এ স্কয়ারে যেন নরক নেমে এসেছিল, লেখা হয়েছিল দমন–পীড়ন আর নির্বিচার হত্যার এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যার প্রকৃত চিত্র চীনের কর্তৃত্ববাদী সরকার বিশ্ববাসীর সামনে কোনো দিন আসতে দেয়নি।
তবে আলোকচিত্রীদের কয়েকটি ক্লিক সেদিন তিয়েনআনমেন ও এর আশপাশের এলাকায় কী ঘটেছিল, তা বোঝার জন্য যথেষ্ট ছিল।
সে বছর এপ্রিল থেকে টানা বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে চীন সরকার মে মাসের শেষ ভাগে সামরিক আইন জারি করে। কিন্তু তাতেও বিক্ষোভকারীদের দমানো যায়নি।
জুনে সেনাবাহিনী-বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধতে শুরু করলে সরকার সেনাবাহিনীকে বিক্ষোভের কেন্দ্রস্থল তিয়েনআনমেন স্কয়ার খালি করার নির্দেশ দেয়।
৪ জুন ট্যাংকের একটি বড় বহর তিয়েনআনমেন স্কয়ারের দিকে যাচ্ছিল। জলপাই সবুজ রঙের বিশালাকারের ভয়ালদর্শন ট্যাংক একের পর এক সারি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে।
ট্যাংকের সারি এগিয়ে আসছিল, হঠাৎই দেখতে খুব সাধারণ ঘরানার এক ব্যক্তি সড়কের মাঝখানে ট্যাংকবহরের গতিপথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়েন।
চলন্ত ট্যাংকের বিশাল বহরটি এই ব্যক্তিকে ভয় দেখাতে পারেনি। তিনি অবিচল দাঁড়িয়ে আছেন, প্রথম ট্যাংকটি তাঁর একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি হাত নেড়ে সেগুলোকে ফিরে যেতে ইশারা করেন। সামনের ট্যাংকটি তাঁকে এড়িয়ে যেতে এদিক-ওদিক ঘুরে সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। তিনিও ঘুরে ঘুরে ট্যাংকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। একপর্যায়ে তাঁকে একটি ট্যাংকের ওপর উঠে যেতে দেখা যায়, সেই ছবিও রয়েছে।
পরে অজ্ঞাতনামা আরও দুই ব্যক্তি তাঁকে সেখান থেকে টেনে সরিয়ে নেন। সব মিলিয়ে মাত্র মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এত সব ঘটনা ঘটে যায় বলে পরে নানা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেখানে উপস্থিতি আলোকচিত্রীরা।
বিক্ষোভের শুরু যে পথে
গত শতকের আশির দশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বড় ধরনের বদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল চীন। দেশটিতে বেসরকারি খাতে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি দিয়েছিল ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি। বিদেশি বিনিয়োগও আসা শুরু করেছিল। চীনের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনমানকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সেই সময়ে দেশটির নেতা দেং জিয়াওপিং।
অর্থনীতির বিকাশে সরকারের এই তৎপরতা ঘিরে দুর্নীতির উৎসবও শুরু হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। দলের অনেকেই মনে করতেন, অর্থনীতির এই পরিবর্তন আরও দ্রুত হওয়া উচিত। অনেকে আবার কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিলেন। এমন এক পরিস্থিতিতে আশির দশকের মাঝামাঝি চীনে ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে।
ছাত্রদের ক্ষোভের কারণ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, তার বাস্তবায়নে ধীরগতি ও দুর্নীতি। ১৯৮৯ সালের শুরুতে আন্দোলন জোরেশোরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
ছাত্র বিক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালে কমিউনিস্ট পার্টির উদারপন্থী নেতা হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যু। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি মারা যান। হু ইয়াওবাং দেশে অর্থনৈতিক বিকাশের পক্ষে ছিলেন।
১৯৮৬-৮৭ সালে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে চীনে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, হু ইয়াওবাং সেই আন্দোলন দমনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আন্দোলন কয়েক সপ্তাহ ধরে চলার জেরে ১৯৮৭ সালের শুরুতে হু ইয়াওবাংকে কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ইয়াওবাংয়ের মৃত্যু বিক্ষোভরত ছাত্র-জনতাকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিল।
হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুর পরদিন চীনের কয়েকটি শহরে ছাত্ররা শোক প্রকাশ করতে জড়ো হন। শোকসভাগুলো দ্রুতই বিক্ষোভ-সমাবেশে পরিণত হয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ জানাতে চীনের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা রাজধানী বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে জড়ো হতে শুরু করেন।
১৩ মে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশনে বসেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের আলোচনায় বসতে রাজি করানো। শিক্ষার্থীরা যে সংস্কারের দাবি তুলেছিলেন, তাতে সমর্থন জানিয়ে সে সময় সারা দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বেইজিংয়ে জড়ো হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
১৯ মে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। সেদিন সন্ধ্যায় অনশন শেষ করেন শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরদিনই অবস্থান বদল করে সরকার, কঠোর হাতে বিক্ষোভ দমন করতে বেইজিংয়ে সামরিক আইন জারি করা হয়। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠেন বিক্ষোভকারীরা।
রাজধানীসহ সারা দেশের রাজপথে নামেন লাখ লাখ বিক্ষোভকারী। এদিকে সামরিক আইন কার্যকর করতে রাজধানী ঘিরে প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার সেনা জড়ো করা হয়।
২ জুন চীনের পিপলস আর্মির সঙ্গে প্রথমবার মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়ান বিক্ষোভকারীরা। খালি হাতে সশস্ত্র সেনাদের অগ্রগতি ঠেকিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা।
৪ জুন রাতে সরকার বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার খালি করতে প্রয়োজনে গুলি চালাতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয় বলে জানা যায়।
রাতের আঁধারে চীনের সেনাবাহিনী ট্যাংক, মেশিন গান, লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনারা নির্বিচারে গুলি চালান। সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যানগুলো যখন তিয়েনআনমেন স্কয়ারে পৌঁছায়, বিক্ষোভে ক্লান্ত ছাত্ররা তখন ছিলেন ঘুমিয়ে।
কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন
৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কয়ার ও আশপাশের এলাকায় সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ মানুষ নিহত হন বলে সে সময় জানিয়েছিল চীন সরকার। তাঁদের মধ্যে শতাধিক সেনাসদস্য ছিল বলেও দাবি করেছিল তারা।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী, সেদিন নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে।
তবে সে সময়ে চীনে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত অ্যালেন ডোনাল্ড গোপন কূটনৈতিক চ্যানেলে যে খবর পাঠিয়েছিলেন, তাতে ১৯৮৯ সালের ৩ ও ৪ জুন চীনে অন্তত ১০ হাজার বিক্ষোভকারীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানানো হয়। ২০১৭ সালে গোপন ওই তথ্য প্রকাশ করা হয়।
৪ জুন থেকেই গণহারে ধরপাকড় চালায় চীন সরকার, ১ হাজার ৬০০–এর বেশি বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়, ২৭ জনকে দেওয়া হয় ফাঁসি।
চীনে বহুদিন তিয়েনআনমেনের বিক্ষোভ ও ‘ট্যাংকম্যান’ নিয়ে কথা বলা নিষেধ ছিল। সেই সঙ্গে ট্যাংকম্যানের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা-ও রয়ে গেছে পর্দার আড়ালেই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস