সৌরশক্তি উৎপাদনে এগিয়ে কোন ১০ দেশ, নেতৃত্বে কারা

একদিকে ঘটছে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন, অন্যদিকে দ্রুত কমছে প্রাকৃতিক জ্বালানি সম্পদের মজুত। এ অবস্থায় বিশ্বকে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হচ্ছে। আর নবায়নযোগ্য শক্তির এক বড় উৎস সৌরশক্তি। অনেক দেশ সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং তা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। অন্যান্য দেশের জন্য তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তা ব্যবহারে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, চীন সৌরশক্তি ব্যবহার করে ৩৯৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সৌরশক্তি ব্যবহার করে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা পূরণে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা ১০ দেশ নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।

চীন

চীনের শানডং প্রদেশে একটি ফটোভোল্টিক পাওয়ার স্টেশনের সোলার প্যানেলগুলো পরীক্ষা করে দেখছেন শ্রমিকেরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সৌরশক্তি খাতে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য চীনের। ২০২২ সালে বিশ্বের ৭৭ দশমিক ৮ শতাংশ সৌর প্যানেল স্থাপন করেছে চীন। এর মাধ্যমে তারা ৩৯৩ গিগাওয়াট (১ গিগাওয়াট=১০০০ মেগাওয়াট) সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার (আইইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাকি বিশ্ব যে সৌর প্যানেল তৈরি করেছে, ২০২৩ সালে চীন একাই এর চেয়ে বেশি প্যানেল তৈরি করেছে। ২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বে উৎপাদিত মোট নবায়নযোগ্য শক্তির প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারে চীন।

এশিয়ার এ দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে সৌরশক্তি থেকে যে জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল, তা কয়েক বছর আগেই পূরণ করে ফেলবে বলেও আইইএ আশা প্রকাশ করেছে।

চীন ২০৩০ সালের মধ্যে ১ হাজার ২০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের লক্ষ্য ঠিক করেছে। ২০৬০ সালের মধ্যে চীন তাদের কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে একটি সোলার পাওয়ার প্যানেল
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সৌরশক্তি থেকে জ্বালানি উৎপাদনে চীনের পরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়ার বাইরে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি সৌর প্যানেল উৎপাদন করে এবং এ থেকে উৎপাদিত জ্বালানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোক্তা দেশ।

২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ওই বছর ১১৩ গিগাওয়াটের কিছু বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছিল, যা জাপানের চেয়ে প্রায় দেড় গুণ।

২০২৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এ সক্ষমতা ৩৭৭ গিগাওয়াটে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাপান

জাপানের নামিয়ে টাউনে ফুকুশিমা হাইড্রোজেন এনার্জি রিসার্চ ফিল্ডের পাশে একটি সোলার পাওয়ার ফার্ম
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১১ সালে ফুকুশিমা দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনে অন্যান্য উৎসের ওপর জোর দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে জাপান। দেশটি ২০২২ সালে ৮৩ গিগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করে।

জাপান সরকার ক্রয়মূল্যে ভর্তুকি, করছাড় ও আরও কিছু ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে দেশজুড়ে সৌরশক্তি উৎপাদনে উৎসাহ দিচ্ছে। ২০২২ সালে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ১০ শতাংশ ছিল সৌরবিদ্যুৎ।

জাপান ২০৩০ সালের মধ্যে ১০৮ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। এ ছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে নিজেদের কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে চায় এশিয়ার দেশটি।

ভারত

ভারতের গুজরাটে একটি সোলার পার্কে সোলার প্যানেল পরিষ্কার করছেন এক শ্রমিক
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০২২ সালে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ভোক্তা দেশ—উভয় তালিকাতেই ৪ নম্বরে ছিল ভারত। ওই বছর দেশটি ৬৩ গিগাওয়াটের কিছু বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

ভারত এ খাতে নিজেদের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে ভারত ২০২২ সালের মধ্যে ২০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল।

ভারতের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন করা। এর মধ্যে ২৮০ গিগাওয়াট আসবে সৌরশক্তি থেকে।

জার্মানি

জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের রাজধানী মিউনিখে একটি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সৌরশক্তি থেকে জ্বালানি উৎপাদনে ইউরোপের নেতৃত্ব দিচ্ছে জার্মানি। দেশটি ২০২২ সালে ৬৬ দশমিক ৬ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে। যদিও দেশটিতে খুব একটা সূর্যালোক পাওয়া যায় না।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে কিছুটা পরিবর্তনের ফলে জার্মানিতে সৌর প্যানেল স্থাপন খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। তারপরও ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটি ২১৫ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

২০২৩ সালে জার্মানিতে রেকর্ড ১০ লাখ সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়, যা থেকে দেশটির বিদ্যুৎ গ্রিডে ১৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ব্যক্তিগতভাবে বসানো সোলার প্যানেল থেকে এসেছে।

অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ায় সৌরবিদ্যুতের একটি বড় অংশ আসে বাড়ির ছাদে স্থাপন করা সোলার প্যানেল থেকে। সিডনিতে একটি বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যদি মাথাপিছু হিসাব আমলে নেওয়া হয়, তবে সোলার প্যানেল স্থাপনে সবচেয়ে এগিয়ে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির ক্লিন এনার্জি কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মোট নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রায় ২৬ শতাংশ এসেছে বাড়ির ছাদে স্থাপিত সোলার প্যানেল থেকে। ওই বছর দেশটিতে মোট প্রায় ২৯ দশমিক ৭ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল।

সরকারের শক্তিশালী পদক্ষেপের ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ির ছাদে স্থাপিত সৌর প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ৬৬ গিগাওয়াটে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

স্পেন

স্পেনে একটি বাড়ির ছাদে স্থাপন করা সোলার প্যানেল
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির পরেই আছে স্পেন। ২০২২ সালে দেশটি সাড়ে ২০ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, যা সেখানে ওই বছর উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ১২ শতাংশ।

স্পেন ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুতের চাহিদার ৭৪ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পূরণ করার পরিকল্পনা করেছে। দেশটি আশা করছে, ২০৫০ সালের মধ্যে তারা শতভাগ নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ–ব্যবস্থায় চলে যেতে সক্ষম হবে।

এ লক্ষ্য পূরণে স্পেন সরকার করছাড়, সোলার প্যানেল স্থাপনে কর হ্রাসসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্পেনেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে।

ব্রাজিল

আকাশ থেকে তোলা ছবিতে ব্রাজিলের আমাজন অঞ্চলে একটি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০২২ সালের শেষ নাগাদ লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে অবদানের দিক থেকে সৌরবিদ্যুৎ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। দেশটি সে বছর প্রায় ২৪ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে, যা বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনকে ছাড়িয়ে গেছে।

ব্রাজিলে সারা বছরই কড়া রোদ থাকে। এ কারণে দেশটি সৌরশক্তি খাতে বিনিয়োগের শীর্ষ গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। এরই মধ্যে দেশটিতে এ খাতে ২ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ এসেছে।

ব্রাজিলের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৭ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করা।

ইতালি

ইতালিতে একটি সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট। পাশেই উইন্ড টারবাইন দেখা যাচ্ছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউরোপের যে দেশগুলো সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের জ্বালানির চাহিদা পূরণ করতে চাইছে, সেগুলোর অন্যতম ইতালি। ২০২২ সালে দেশটি ২৫ গিগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে। পরের বছর দেশটি এ খাতে বাড়তি আরও ৫ দশমিক ২৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।

ইতালি বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদ থেকে এবং বৃহৎ আকারে সৌরশক্তি অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা করেছে। এ জন্য সরকার থেকে করছাড়, ক্রয়মূল্যে ভর্তুকি ও কর হ্রাসসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

১০

দক্ষিণ কোরিয়া

নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানির চাহিদা পূরণ করতে সৌরশক্তির পাশাপাশি বায়ুশক্তিকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০২২ সালের শেষ নাগাদ ২৪ গিগাওয়াটের বেশি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। আগের বছরের চেয়ে যা ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।

দক্ষিণ কোরিয়া এখনো সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে সামনের সারির দেশ হয়ে উঠতে পারেনি। তবে দেশটির এনার্জি ট্রানজিশন রোডম্যাপের লক্ষ্য, ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য শক্তির অবদান ৭ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা। যেখানে সৌরশক্তির পাশাপাশি বায়ুশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

তথ্যসূত্র: যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সানসেভ