শীতল উত্তর মেরু থেকে শুরু করে তপ্ত সাহারা—আমাদের এ পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় মারাত্মক চরম তাপমাত্রা বিরাজ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত অঞ্চল কোনটি জানেন কি? সেখানে তাপমাত্রা এত বেশি যে আর কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে তা ফুটন্ত গরম পানির তাপমাত্রা ছুঁয়ে ফেলত। যদিও সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হওয়া অঞ্চলের তালিকা সব সময় একই থাকে না। তবে গড় তাপমাত্রার ভিত্তিতে ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত ১০টি অঞ্চল নিয়ে প্রথম আলোর আজকের আয়োজন।
বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালির ফারনাস ক্রিক। সেখানে ১৯১৩ সালের ১০ জুলাই তাপমাত্রা ৫৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে ডেথ উপত্যকায় তাপমাত্রা গড়ে ৪৫ ডিগ্রি থাকে। অবশ্য এটা বাতাসের তাপমাত্রা। ভূমি এর থেকে অনেক বেশি গরম থাকে। ১৯৭২ সালের ১৫ জুলাই ডেথ ভ্যালিতে ভূমির তাপমাত্রা ৯৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। ফুটন্ত গরম পানির তাপমাত্রা এর থেকে সামান্য বেশি।
আরও কয়েকটি জায়গা থেকে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হওয়ার দাবি করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনোটিই যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া যায়নি, যেমন ১৯২২ সালে লিবিয়ার একটি জায়গার তাপমাত্রা ৫৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করার দাবি করা হয়। কিন্তু ২০১২ সালে ডব্লিউএমও এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ওই তাপমাত্রা ‘সঠিকভাবে রেকর্ড’ করা হয়নি, প্রায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গরমিল হয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে তিউনিসিয়ার কেবিলিতে। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সেখানে ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত রেকর্ড হওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এটি। রেকর্ড ভাঙা তাপমাত্রার পাশাপাশি পুরাপ্রস্তর যুগের মানুষ্য বসতি থাকার চিহ্ন পাওয়া যাওয়ার কারণেও কেবিলি বেশ পরিচিত। বলা হয়, কেবিলি শহরের কাছে প্রায় দুই লাখ বছর আগের পুরাপ্রস্তর যুগের পাথরের তৈরি হাতিয়ার পাওয়া গেছে।
২০১৭ সালের ২৯ জুন স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৫১ মিনিট থেকে ৫টা পর্যন্ত ইরানের আহভাজে তাপমাত্রা ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের রাজধানী আহভাজে প্রায় ১৩ লাখ মানুষ বসবাস করে। শহরটি ৯টি সেতু, বিশেষ করে ব্ল্যাক ব্রিজ ও হোয়াইট ব্রিজের জন্য বিখ্যাত।
১৯৪২ সালের ২১ জুন বর্তমান ইসরায়েলের তিরাত জিভিতে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ডব্লিউএমও ইসরায়েলকে ইউরোপের অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে। এ কারণে এটিকে এ মহাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
জর্ডান নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত তিরাত জিভি ইসরায়েল-জর্ডান সীমান্তে অবস্থিত। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানে মাত্র ৯৭৫ জন মানুষ বসবাস করে।
পৃথিবীর পঞ্চম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে কুয়েতের মিতরিবাহতে। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই মিতরিবাহতে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৫৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। ডব্লিউএমও কর্তৃপক্ষ ওই রেকর্ড যাচাই করেছে এবং এটিকে এশিয়ার সবচেয়ে গরম স্থানের স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় ৭৬ বছর ধরে এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
বিশ্বের সবচেয়ে উত্তপ্ত অঞ্চলের একটি মধ্যপ্রাচ্য, সেখানে কয়েকটি স্থানে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর রেকর্ড করা হয়েছে। ওই সব স্থানের একটি ইরাকের বসরা। ২০১৬ সালের ২২ জুলাই বসরায় ৫৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। এর এক দিন আগেই কুয়েতের মিতরিবাহতে একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল। ইরাকের বসরা নগরীতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বসবাস করে। নগরীটি আরব উপদ্বীপের শাত আল-আরব নদীর পাড়ে অবস্থিত।
পৃথিবীর সপ্তম সর্বোচ্চ উত্তপ্ত স্থান পাকিস্তানের তুরবত। ২০১৭ সালের ২৮ মে সেখানে ৫৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়। ডব্লিউএমও নিশ্চিত করেছে যে তুরবতে রেকর্ড হওয়া এ তাপমাত্রা ছিল সেই সময় রেকর্ড করা চতুর্থ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা।
এশিয়ার সবচেয়ে বেশি গরম শহরগুলোর একটি তুরবত। শহরটি পাকিস্তানের দক্ষিণ–পশ্চিমের বেলুচিস্তান অঞ্চলের কেচ নদীর পাড়ে অবস্থিত।
২০০২ সালের জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল–জাজিরা বর্ডার গেটে তাপমাত্রা ৫২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে আবার সেখানে তাপমাত্রা প্রায় রেকর্ড ছুঁয়েছিল। সেবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৫১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রায় ১৫ মিনিট এই তাপমাত্রা বিরাজ করেছিল। বাতাসে তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি অনুভূত হলে সেটিকে প্রায় অসহ্য বলা হয়।
১৯৯৫ সালের ২৮ জুলাই মেক্সিকোর মেক্সিক্যালি ভ্যালিতে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এটি পৃথিবীতে রেকর্ড হওয়া নবম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। তবে শুধু তীব্র গরমই নয়, এ ভ্যালিতে মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রও রেকর্ড হয়েছে। ভ্যালিটি মেক্সিকোর উত্তরের বাজা ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত। তীব্র তাপের কারণে এ অঞ্চলকে ‘দ্য সিটি দ্যাট ক্যাপচার্ড দ্য সান’ (সূর্যকে ধরে ফেলা শহর) নামেও ডাকা হয়। মেক্সিকোর সবচেয়ে চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া অঞ্চলের একটি এটি। জুলাইয়ে এখানে গড় তাপমাত্রা থাকে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে গড়ে ২১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
সৌদি আরবের জেদ্দায় ২০১০ সালের ২২ জুন ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ওই অঞ্চলে এটি রেকর্ড সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর তিন দিন আগে জেদ্দার কাছের আল-আশায় ৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীন বন্দর নগরী জেদ্দা। পবিত্র নগরী মক্কায় প্রবেশের প্রধানপথ এ জেদ্দা। এখানে ৪৬ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে।