বিশেষ সাক্ষাৎকার: অধীর রঞ্জন চৌধুরী

জোট-জট জটিল, রাতারাতি শোধরানোর নয়

বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ ওপরে ওপরে যতটা নিস্তরঙ্গ দিঘির মতো টলটলে, ভেতরে-ভেতরে ততটাই চঞ্চল। শীর্ষ স্তরে নেতাদের মাখামাখি নিচু স্তরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়া তো দূরের কথা, সৃষ্টি করেছে চরম বিভ্রান্তির। জোটের এই জট কীভাবে কাটানো যাবে, সেই সূত্র এখনো অধরা। কীভাবে এই জট খোলা যাবে, তার মরিয়া সন্ধান চলছে। জোটের পূর্বাপর বুঝতে অধীর রঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী, রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গ
প্রশ্ন:

চার রাজ্যের চার রাজনৈতিক দল এই বিভ্রান্তির জাঁতাকলে পিষছে। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, দিল্লি ও পাঞ্জাব। চার যুযুধান দল তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি ও সিপিএম। এই দলগুলোর রাজ্যস্তরীয় নেতা-কর্মীরা তো এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, কীভাবে এই জোট-জট ছাড়ানো যাবে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: বিভ্রান্তি তো আছেই। একদিকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তার তাগিদ। সময়ের দাবি। দেশ বাঁচাতে লোকসভা ভোটে বিজেপিকে হারানোর উপলব্ধি। অন্যদিকে রয়েছে রাজ্যস্তরে পারস্পরিক তীব্র রাজনৈতিক সংঘাত। এই দুই পরস্পরবিরোধী বাস্তবতা কী করে অস্বীকার করা যাবে?

প্রশ্ন:

সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে সীতারাম ইয়েচুরি পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালার রাজ্যস্তরের নেতাদের জোট নিয়ে আশ্বস্ত করতে পারেননি। তাঁর মতো অবস্থা কি আপনারও? বিভ্রান্ত?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: এটা মানতেই হবে, বিষয়টা মোটেই সাবলীল নয়; বরং অত্যন্ত জটিল। সবকিছু দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে বলার মতো সময় এখনো আসেনি।

এত দিন ধরে একটা রাজনৈতিক লড়াই চলছে। সংঘর্ষ হচ্ছে। হঠাৎ করে রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে, তা কি হয়? একটা প্রক্রিয়া সবে শুরু হয়েছে। সবাই যদি মনে করে এর সমাধান হওয়া উচিত, মিটমাট করা উচিত, তা হলে হবে।
প্রশ্ন:

ওপর মহলে জোট দিন দিন পোক্ত হচ্ছে। তার নানা উদাহরণ সংসদের ভেতর ও বাইরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু নিচু মহলে? পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস, কেরালায় কংগ্রেস জোটের সঙ্গে বামপন্থীদের জোট এবং দিল্লি ও পাঞ্জাবে কংগ্রেসের সঙ্গে আম আদমি পার্টির সংঘাত কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা হলে ‘ইন্ডিয়া’ জোট শক্তিশালী হবে কী করে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: বলা কঠিন। সংশয় যথেষ্ট সংগত। কারণ, এই যে জোটটা হলো, সেটা কোনো সাবলীল বিষয় নয়। এত দিন ধরে একটা রাজনৈতিক লড়াই চলছে। সংঘর্ষ হচ্ছে। হঠাৎ করে রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে, তা কি হয়? একটা প্রক্রিয়া সবে শুরু হয়েছে। সবাই যদি মনে করে এর সমাধান হওয়া উচিত, মিটমাট করা উচিত, তা হলে হবে।

প্রশ্ন:

তার কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: এটা তো কংগ্রেসের একার দায়িত্ব নয়। জোটে যারা আছে, সবাইকেই দায়িত্ব নিতে হবে। শুধু কংগ্রেস ত্যাগ স্বীকার করবে, অন্যরা নয়, তা তো হতে পারে না। ত্যাগ স্বীকার সবাইকেই করতে হবে।

প্রশ্ন:

সেটা কি উপলব্ধি হয়েছে? এই ত্যাগ স্বীকারের বিষয়টি?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: সেই উপলব্ধি না হলে এই জায়গায় পৌঁছানো যেত না। এখন আঞ্চলিক দলগুলোকে ঠিক করতে হবে। তাদের প্রত্যেকের অনেক রকমের বাধ্যবাধকতা আছে। পরিস্থিতি বিচারে তাদের বিবেচনা করতে হবে। কংগ্রেসের কাছে জোট গঠন নতুন নয়। কংগ্রেস বরাবরই খোলামনে সব বিবেচনা করেছে। ইউপিএ গঠন কংগ্রেসই করেছিল। হারার পর (২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে) থেকেই কংগ্রেস জোটের কথা বলতে শুরু করেছে। বলছে, জোট গড়লে এমন ফল হবে না। ভারতের মোট ভোটের মাত্র ৩৭ শতাংশ বিজেপির। বাকি ৬৩ শতাংশ কিন্তু বিরোধীদের। পাটিগণিতের অঙ্ক ঠিক থাকলে বিজেপি জিততে পারে না।

প্রশ্ন:

এই উপলব্ধি যতটা ওপর মহলে, তৃণমূল স্তরে কি তা দেখা যাচ্ছে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: এখনো নয়। সমস্যা তো আছে। হুট করে সব ঠিক হওয়ার নয়। পশ্চিমবঙ্গে খুবই সমস্যা। প্রতিদিন আমাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। আক্রমণ হচ্ছে। কী করে ছেলেরা মানবে? মনস্তাত্ত্বিক বাধা তো আছেই। রাতারাতি মানা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন:

তা হলে উপায়?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: রাজ্য সরকারকেই তা ঠিক করতে হবে। তার ওপর সব নির্ভরশীল। সরকার যদি প্রতিদিন কংগ্রেসের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়, মারধর করে, জেলে ঢোকায়, খুন করে, তা হলে কংগ্রেসের কোন লোককে আমি বলতে পারব যে ভাই সবাই মিলেমিশে চলো। মিলেমিশে চলার মতো পরিবেশ তো রাজ্য সরকারকেই তৈরি করতে হবে। সেটা আমাদের দায়িত্ব নয়।

প্রশ্ন:

জোটের পাটনা বৈঠকের পর রাজ্যস্তরে কোনোরকমের ইতিবাচক ইঙ্গিত কি দেখা যাচ্ছে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: একেবারেই নয়। কোনোরকমের পজিটিভ ডেভেলপমেন্ট (ইতিবাচক অগ্রগতি) নেই। এখনো সমানে অত্যাচার চলছে। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। পাটনা বৈঠকের সময়েই তো রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলো! ভোটের চেহারা তো দেখলেন? ‘পাটনা ডকট্রিন’ কি চলল? দেখুন, রাজ্য সরকার যদি না মানে, তা হলে আমরা কিছুই করতে পারি না। তারা যদি মনে করে দিল্লিতে সব ঠিক থাকবে আর রাজ্যে আমরা যা খুশি তা-ই করে যাব, তা কি বরদাশত করা যায়?

প্রশ্ন:

রাজ্য সরকার তো রাজ্যের বিরোধীদের দোষারোপ করছে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: রাজ্যের বিরোধীদের কি সেই ক্ষমতা আছে? আমরা প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছি। আমাদের লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পঞ্চায়েত বোর্ড গঠনের জন্য। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে জেলে ঢোকানো হচ্ছে।

প্রশ্ন:

এই পরিস্থিতিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে আপনাকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: আমার কোনো দায়িত্ব নেই। আমরা রাজ্যে শূন্য। দায়িত্ব নিতে হবে রাজ্য সরকারকে। শাসক দলকে। তাদেরই জোটের উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। সেই দায়িত্ব আমার নয়। ওদের। অত্যাচার ওরা করছে। ওদেরই তা বন্ধ করতে হবে। আমার কোনো ক্ষমতাই নেই। আমি কি পুলিশকে বলতে পারি ওহে তোমরা থেমে যাও? সেই হুকুম তো রাজ্যকেই দিতে হবে? তা না করলে যেমন চলছে তেমনই চলবে। আমি কাকে বোঝাতে যাব?

প্রশ্ন:

এই অবস্থা তো জোটের পক্ষে ভালো নয়। এর তো একটা প্রভাবও পড়বে?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: পড়লে পড়বে। আমার কী করার আছে? আমি কী করতে পারি, সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না। আমাকে তোমরা খুন করবে অথচ আমি তোমাদের ফুল দিয়ে পুজো করব, তা হয় নাকি? যা হয় না, তা হয় না। কাজেই আপনাকে ঠিক করতে হবে কীভাবে চলবেন। কীভাবে জোট এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস কোনো শক্তি নয়। তৃণমূলই শক্তিশালী। আমি মার খাব আবার বন্ধুত্ব করব, এটা হয় না। বন্ধুত্বের বাতাবরণ তাদেরই সৃষ্টি করতে হবে।

প্রশ্ন:

একটা তত্ত্ব এই যে রাজ্য দখলের লড়াই যেমন চলছে তেমনই চলুক, কেন্দ্র দখলের জন্য বিজেপিকে হারাতে সবাই হাত মেলাক।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: আমি জানি না। এসব তত্ত্বটত্ত্ব আমি বুঝি না। আমার মাথায় ঢোকে না। আমি এই বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ। যাঁরা জানেন তাঁদের জিজ্ঞেস করুন কীভাবে এমন হতে পারে। হওয়া সম্ভব কি না। আমরা মানুষ। আমরা রোবট নই যে সুইচ টেপা মাত্র অন হলাম, অফ হলাম, প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ করে গেলাম! আমরা মানুষ। কার্যকারণ বিবেচনা করি। যুক্তির পিঠে যুক্তি খাড়া করি। আমাদের মন আছে। ভাবনা আছে। মনস্তত্ত্ব আছে। কাজেই এটা কী করে সম্ভব, বলতে পারি না। দিল্লি জানতে পারে। তারা যদি জোর করে, তা হলে যা হওয়ার হবে। কাউকে খুশি করার জন্য খুন হলেও বন্ধুত্ব বজায় রাখব।

প্রশ্ন:

এই চার রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাই কি সবচেয়ে জটিল?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: অন্যদের কথা বলতে পারব না। আর কোনো রাজ্যে এমন অত্যাচার হয় কি না, জানা নেই। আমি আমার রাজ্যের কথা বলতে পারি। এখানে অকথ্য অত্যাচার চলছে। একতরফা অত্যাচার। লকআপে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। সবাই জানে। চোখের ওপর সবাই দেখতে পাচ্ছে। প্রচারমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।

প্রশ্ন:

আপনার দলের সর্বোচ্চ নেতারা কি এসব জানেন না?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: সবাই জানেন। না জানার কোনো কারণ নেই। তবু কেউ জানতে চাইলে প্রকৃত অবস্থাটা কী, তা জানাব। যা সত্য তা-ই বলব। বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলব না। বাড়তি কিছু বলব না।

প্রশ্ন:

অর্থাৎ জোট হয়েছে, কিন্তু এই বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হয়নি।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: অন্য কোনো রাজ্যে হয়েছে কি না, বলতে পারব না। পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। অন্তত আমার জ্ঞানত কিছু হয়নি, এটুকু বলতে পারি। রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে কেউ আমার মতামতও জানতে চাননি।

প্রশ্ন:

অথচ জোট নেতারা সবাই বুঝতে পারছেন দেশ এক অভূতপূর্ব সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: অভূতপূর্ব তো বটেই। যাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন, তাঁরা মনে করেন সংখ্যাধিক্যই শাসনের শেষ কথা। মনে করেন, সংখ্যা আছে বলে যা খুশি তা-ই করা যায়। এমন আগে কখনো হয়নি! এটা পুরোপুরি নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র, ইলেকটোরাল অটোক্রেসি! ভোটে জিতছে ঠিকই কিন্তু স্বৈরতন্ত্র! এ দেশে এখন কোনো নিয়মকানুনের বালাই নেই। যতটুকু বেঁচে আছে, তা বিচার বিভাগের কল্যাণে। আগামী দিনে তাদের হাল কী হবে জানি না; কারণ, বিচার বিভাগের ওপরেও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। যারা স্বৈরাচারী, তারা বিচার বিভাগকেও পকেটে ভরে ফেলতে চায়। নিরন্তর সেই চেষ্টা চালায়। তবে এখন পর্যন্ত এই বিচার বিভাগের জন্যই কিছুটা শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে।

প্রশ্ন:

রাহুল গান্ধী সংসদ সদস্য পদ ফেরত পেলেন ওই শ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকু রয়েছে বলেই। কিন্তু জোটের অনেকে তাতে শঙ্কার অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছেন। রাহুল জোটের নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে উঠবেন বলে ভয় পাচ্ছেন।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: দুটো বিষয়ে নজর করুন। কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে বাড়ছে বলে অন্য বিরোধী দলগুলো কংগ্রেসের কাছাকাছি আসছে। না হলে কি আসত? কাল কংগ্রেস শূন্য হয়ে গেলেই অন্য ছবি দেখা যাবে। দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বের প্রশ্নে কংগ্রেস বরাবর সংযত আচরণ করে এসেছে। ওঁরা কি সোনিয়া গান্ধীকে দেখেননি কীভাবে হেলায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন? গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতার আর কত প্রমাণ কংগ্রেসকে দিতে হবে? এই পরিবার থেকে দুজন দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। রাহুল চাইলে আগেই মন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু পদের জন্য লালায়িত তিনি হননি। এসব তৈরি করা গুজব। কাল্পনিক শঙ্কা। আজকের ক্ষমতাসীনেরা এই অ্যাজেন্ডা তৈরি করছে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য। রাহুলকে যাঁরা চেনেন তাঁরা জানেন, উনি লোভী নন। কোনো দিন ছিলেনও না।

প্রশ্ন:

তা হলে আপনি মনে করছেন জোট শরিকদের আশঙ্কার কোনো কারণ নেই?

অধীর রঞ্জন চৌধুরী: রাহুল গান্ধী আগ্রাসী মানসিকতার মানুষ নন। যাঁরা এসব মনে করছেন, তাঁরা রাহুলকে জানেন না। ওঁর মানসিকতার ভুল ব্যাখ্যা করছেন। একটা কথা বলি, আশঙ্কা নিয়ে কিন্তু রাজনীতি হয় না। রাজনীতিটা বিশ্বাস নিয়ে করতে হবে।