কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এখন প্রযুক্তি অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দুতে। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা থেকে শুরু করে সৃজনশীলতা—সবখানেই এআই বদলে দিচ্ছে কাজের ধরন। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছেন এমন কয়েকজন মানুষ, যাঁরা শুধু উদ্ভাবনই করছেন না, বরং এআই নিয়ে বিশ্বব্যাপী ভাবনা, নীতি ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সাময়িকী এআই ম্যাগাজিন এমন ১০ জন প্রভাবশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যক্তিত্বের তালিকা প্রকাশ করেছে। তাঁদের কাজ, দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের মধ্য দিয়েই গড়ে উঠছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন যুগ।
বিশ্বখ্যাত গবেষক ও শিক্ষাবিদ অ্যান্ড্রু এনজি ‘ডিপলার্নিং ডট এআই’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ‘কোরসেরা’ ও ‘ল্যান্ডিংএআই’–এরও সহপ্রতিষ্ঠাতা। গুগল ব্রেন প্রকল্প ও চীনা প্রতিষ্ঠান ‘বাইদু’তে তাঁর নেতৃত্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় এসেছে যুগান্তকারী পরিবর্তন।
‘টাইম ১০০’–এর প্রভাবশালী এআই ব্যক্তিত্বদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন এনজি। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গবেষণা করেছেন, তা থেকেই রোবট অপারেটিং সিস্টেম তৈরি হয়েছে।
মেটা কোম্পানির প্রধান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিজ্ঞানী ইয়ান লেকান ‘এআই–এর গডফাদার’ নামে পরিচিত। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই বিজ্ঞানী কনভলিউশনাল নিউরাল নেটওয়ার্ক বা ‘সিএনএন’ উদ্ভাবন করেন, যা আধুনিক কম্পিউটার দৃষ্টি বা ভিশন প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে। ২০১৮ সালে তিনি কম্পিউটার বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মাননা টিউরিং পুরস্কার অর্জন করেন।
কানাডার মন্ট্রিয়লের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘মিলা’–এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়োশুয়া বেংজিও ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির অন্যতম পথিকৃৎ। মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি নিউরাল নেটওয়ার্ক ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালে টিউরিং পুরস্কার পাওয়া বেংজিও দায়িত্বশীল ও নৈতিক এআই উন্নয়নের জোরালো কণ্ঠস্বর।
গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট বা জিপিইউ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হার্ডওয়্যারের জগতে বিপ্লব এনেছেন।
এনভিডিয়ার তৈরি জিপিইউ এখন বিশ্বব্যাপী এআই গবেষণা ও মডেল প্রশিক্ষণের মানদণ্ড। তাঁর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে জেনারেটিভ এআই, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা, চিকিৎসা ও সৃজনশীলতায় নতুন গতি এনে দিয়েছে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফেই–ফেই লি ‘এআই–এর গডমাদার’ নামে পরিচিত। তিনি ‘ইমেজনেট’ প্রকল্পের স্রষ্টা, যা কম্পিউটার দৃষ্টি প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। মানবকেন্দ্রিক এআই উন্নয়নের প্রবক্তা এই বিজ্ঞানী ‘এআই ফর অল’ নামে একটি অলাভজনক সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে তিনি বিশ্ব গবেষণাগারে স্থানিক বুদ্ধিমত্তা ও সৃজনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন।
‘ওপেনএআই’–এর প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান বিশ্বব্যাপী আলোচিত ‘চ্যাটজিপিটি’, ‘ডলি’ ও ‘জিপিটি–৪’-এর মতো যুগান্তকারী পণ্য পরিচিত করে তোলেন। তাঁর লক্ষ্য কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা বা এজিআই অর্জন এবং এর সুফল মানবকল্যাণে ব্যবহার করা।
ওপেনএআই ছাড়াও স্যাম অল্টম্যান নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও প্রযুক্তিনির্ভর বিনিয়োগ খাতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।
‘গুগল ডিপমাইন্ড’ ও ‘আইসোমরফিক ল্যাবস’–এর প্রধান নির্বাহী ডেমিস হাসাবিস কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা গবেষণার অগ্রদূত। তাঁর নেতৃত্বে ডিপমাইন্ড তৈরি করে ‘আলফাগো’ ও ‘আলফাফোল্ড’, যা যথাক্রমে বোর্ড গেম ও প্রোটিন গঠনের জটিল সমস্যা সমাধান করেছে। ২০২৪ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী।
‘ডিপ লার্নিংয়ের জনক’ হিসেবে পরিচিত জিওফ্রে হিন্টন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি নিউরাল নেটওয়ার্ক ও ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদম উদ্ভাবন করেন, যা আধুনিক ভাষা চিনতে পারা ও ছবি বিশ্লেষণের ভিত্তি তৈরি করে। ২০২৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি।
‘ওপেন মেশিন’–এর প্রধান নির্বাহী অ্যালি মিলার যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কম বয়সী নারী এআই–বিশেষজ্ঞদের একজন। তিনি ‘অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস’-এ স্টার্টআপ খাতের মেশিন লার্নিং বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন এবং ‘আইবিএম’-এ ইতিহাসের সবচেয়ে কম বয়সী নারী এআই পণ্য নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ওপেন মেশিনের প্রধান নির্বাহী ও ফরচুন ৫০০ তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপদেষ্টা হিসেবে অ্যালি মিলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা গড়ে তোলা ও সম্প্রসারণ করতে সহায়তা করেন। তিনি ‘গার্লস অব দ্য ফিউচার’ উদ্যোগের সহপ্রতিষ্ঠাতা, যা তরুণী শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে আগ্রহী করে তুলছে।
‘বার্নার্ড মার অ্যান্ড কোম্পানি’র প্রতিষ্ঠাতা বার্নার্ড মার বিশ্বখ্যাত ভবিষ্যৎ বিশ্লেষক ও ব্যবসা বিশেষজ্ঞ। তিনি ২০টির বেশি বেস্টসেলার বইয়ের লেখক, যার মধ্যে ‘জেনারেটিভ এআই ইন প্র্যাকটিস’ উল্লেখযোগ্য। লিংকডইন তাঁকে বিশ্বের শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রভাবশালীদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ ছাড়া তিনি নিয়মিত ফোর্বস সাময়িকীর কলাম লেখক। তিনি প্রযুক্তির মানবিক ব্যবহারে গুরুত্ব দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১০ জন উদ্ভাবকের গবেষণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বই আগামী দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গতিপথ নির্ধারণ করবে। কেউ নৈতিক দিক নিয়ে ভাবছেন, কেউ মানবিক প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছেন—তাঁদের হাত ধরেই এগোচ্ছে প্রযুক্তির নতুন যুগ।