ফুটবল নিয়ে জানাশোনায় তাক লাগিয়েছেন যে রেস্তোরাঁকর্মী

ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে বিভিন্ন দেশের ফুটবল ভক্তরা কাতারে আসেন
ছবি: রয়টার্স

কাতারের রাজধানী দোহা এখন যেন ফুটবলের রাজধানী। কারণটা কারও অজানা নয়। সেখানে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল। দোহা এখন বিভিন্ন দেশের ফুটবল ভক্তদের আনাগোনাতেও মুখর। খেলা দেখার পাশাপাশি তাঁরা অবসর সময় এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রেস্তোরাঁয় গিয়ে উপভোগ করছেন ভিন্ন স্বাদের সব খাবার। দোহার নাজমা এলাকায় রয়েছে এমনই একটি রেস্তোরাঁ।

ওই রেস্তোরাঁটি ভারতীয়। সেখানে কেরালাসহ চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের ধাঁচে রান্না করা বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। ওই রেস্তোরাঁয় খাবার পরিবেশনের কাজ করেন আব্বাস কুরি। ফুটবল সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান। পেলে–ম্যারাডোনাসহ অনেক ফুটবল মহাতারকাদের জীবনের গল্প তাঁর ঠোটস্থ। কেউ কেউ তো তাঁকে ফুটবলের এনসাইক্লোপিডিয়া (বিশ্বকোষ) বলছেন।

ফুটবলের নাড়ি-নক্ষত্র জানার কারণে সবার কাছে খুবই পরিচিত মুখ আব্বাস কুরি। রেস্তোরাঁয় বসেই আল–জাজিরার সঙ্গে কথা হয় তাঁর। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ঘানা, ইংল্যান্ড, নাইজেরিয়া, মরক্কোসহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য ভক্ত-সমর্থকদের সঙ্গে নাকি সরাসরি কথা বলেছেন তিনি। আব্বাস বলেন, ‘রেস্তোরাঁয় আসা প্রত্যেক আফ্রিকান ও ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। জানতে চেয়েছি তাঁরা কে কোন দেশ থেকে এসেছেন। তারপর জাতীয় দলের একজন ফুটবলার সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। তখন অধিকাংশ ব্যক্তিই কথা বলা শুরু করেছেন।’

‘মরক্কো ফুটবল দলের সমর্থকেরা আমাকে ভাই বলে ডাকেন’

কয়েক দিন আগে এক সন্ধ্যায় মরক্কোর একদল সমর্থক রেস্তোরাঁয় আসেন। আব্বাস তাঁদের পছন্দের খাবার সরবরাহ করছিলেন। টেবিলে খাবার সরবরাহ করতে করতে তিনি মরক্কোর ফুটবল দলের বর্তমান ও সাবেক খেলোয়াড়দের নাম বলে যাচ্ছিলেন—হাকিম জাইস, আশরাফ হাকিমী, মারুয়ানে চামাখ, নুসাইর মাজরাউ, মুস্তাফা হাদজি। আব্বাস বলেন, ‘নিজ দেশের খেলোয়াড়দের নাম শুনে তাঁরা খুবই খুশি হয়েছিলেন। একপর্যায়ে আমাকে আখি (ভাই) বলে ডাকেন তাঁরা।’

আব্বাস কুরিকে নিয়ে আল–জাজিরার প্রতিবেদন টুইটারে বেশ সাড়া ফেলেছে

আব্বাস কুরি যে শুধু বিশ্বকাপ উপলক্ষে খেলোয়াড়দের নাম মুখস্থ করেছেন তা নয়। সারা বছরই ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের খেলা দেখেন তিনি। এজন্য কখনো কখনো রেস্তোরাঁয় আসা ক্রেতাকে প্রশ্ন করে ফেলেন, ‘গতকালের খেলা দেখেছিলেন।’

বিশ্বকাপ শুরুর আগে যুক্তরাজ্যের ফুটবল ক্লাব চেলসির কিছু সমর্থক কাতার এসেছিলেন। তখন আব্বাসের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁদের। আলাপের একপর্যায়ে দলের সদস্যরা জানতে পারেন আব্বাস ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ভক্ত। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলেন চেলসির সেই সমর্থকেরা। এই ব্যাপারগুলো দারুণ উপভোগ করেন আব্বাস। তিনি বলেন, ‘কেউ আমাকে উপেক্ষা করে না, এড়িয়েও যান না।’

কাতারের রাজধানী দোহার রেস্তোরাঁগুলো ফুটবল ভক্তদের পদচরণায় মুখর
ছবি: রয়টার্স

অতিথিদের খাবার দেওয়ার সময় তাঁদের সঙ্গে কথা বলা যায়। ফুটবল নিয়ে আলাপ সারতে এই সময়টা কাজে লাগান আব্বাস। এর মধ্যে থাকে পুরোনো খেলোয়াড়দের নিয়ে গল্প, নানা দলের খেলোয়াড় সাজানোর বিশ্লেষণ, খেলোয়াড়দের ইনজুরি সংক্রান্ত বিষয়গুলো। তবে ক্রেতাদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে ব্যবসার কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি না সেদিকেও খেয়াল রাখেন আব্বাস। তাই গল্প করতে করতে ক্যাশ কাউন্টারের দিকে একটু পর পর তাকান। খেয়াল রাখেন ম্যানেজার তাঁকে দেখছে কি না বা অন্য কোনো টেবিলে খাবার দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না।

রেস্তোরাঁর খাটুনি শেষে মধ্যরাতে বাসায় ফেরেন আব্বাস কুরি। কিন্তু দীর্ঘ পরিশ্রমও তাঁকে ক্লান্ত করতে পারে না। বাসায় ফিরেই ফুটবলের খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করেন।

সরাসরি ম্যাচ থাকলে দেখেন। অনেক সময় পুরোনো ম্যাচও দেখতে বসেন। কখনো আবার খেলোয়াড়দের নামও মুখস্থ করার চেষ্টা করেন। আব্বাস বলেন, ‘সব সময় অফুরন্ত সময় পাই না। এজন্য বাসায় এসে ইউটিউবে খেলার হাইলাইটস্‌ দেখি।’

আব্বাসের স্মৃতিশক্তি যেন ‘এনসাইক্লোপিডিয়ার’ মতো

আব্বাস কুরির এই প্রতিভা জানতে পারেন এনএস নিসার নামের এক ভারতীয় ক্রীড়া সাংবাদিক। কেরালা থেকে ফুটবল বিশ্বকাপের সংবাদ সংগ্রহ করতে কাতারে এসেছেন তিনি। বিশ্বকাপ শুরুর কয়েক দিন আগে আব্বাসের রেস্তারাঁয় চা খেতে যান। ওই সময় দুজনের পরিচয় হয়। নিসার বলেন, গত তিন দশকের অন্তত কয়েক হাজার খেলায়াড়কে চেনেন আব্বাস।

সাংবাদিক নিসার বলেন, ‘হঠাৎ তাঁর প্রখর স্মৃতি আমার চোখে পড়ে। আমরা সবাই জানি ৯০-এর দশকে ক্লদিও ক্যানিজিয়া আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু, ক্লাব পর্যায় থেকে শুরু করে তাঁর পুরো ক্যারিয়ার আব্বাসের নখদর্পণে। ৯০-এর দশক থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া প্রতিটি দলের খেলোয়াড়দের নাম মনে আছে তাঁর।’ আব্বাসের স্মৃতিশক্তিকে ‘এনসাইক্লোপেডিক’  অভিহিত করেন নিসার।

‘আমি অনেককেই দেখেছি যারা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা ইতালি সম্পর্কে জানেন। কিন্তু মরক্কো, ক্যামেরুন কিংবা সেনেগাল দলের অনেক তথ্য এই মানুষটির জানা আছে,’ বলেন নিসার।

ফুটবল ও খেলোয়াড় সম্পর্কে আব্বাসের জ্ঞানের গভীরতা এত বেশি যে, কখনো কখনো অনর্গল খেলোয়াড়দের ডাকনামও বলতে পারেন। যেমন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তী ফুটবলার পেলের নাম সবার জানা। তবে সৌদি আরবের খেলোয়াড় মাজেদ আবদুল্লাহ ‘মরুভূমির পেলে’ এবং ব্রাজিলের জিকো ‘হোয়াইট পেলে’ নামে পরিচিত, তা জানালেন আব্বাস।

এ তো গেলো দেশভিত্তিক ফুটবলের গল্প। ইতালিয়ান লিগ সম্পর্কেও গাদা গাদা তথ্য জানেন আব্বাস। এসি মিলান ফুটবল ক্লাবের কথাই ধরা যাক। একটা সময় ইতালির ক্লাব ফুটবলে দলটি খুব প্রভাবশালী ছিলো। কিন্তু ‘অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক’ ফুটবল খেলার কারণে দলটি আধিপত্য হারিয়েছে।

আর্জেন্টিনা–পোলান্ড ম্যাচের একটি দৃশ্য
ছবি: রয়টার্স

আব্বাসের ইচ্ছা পূরণ

আব্বাস কুরির জন্ম ১৯৭৬ সালে। তাঁদের পারিবারিক পাটের ব্যবসা ছিলো। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। কেরালায় আব্বাসের শহরটি ছিলো ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত। তবে ছোটবেলায় তেমন একটা ফুটবল খেলার সুযোগ হয়নি আব্বাসের।
১৯৯০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের একটি ম্যাচ দেখে ফুটবল ভক্ত হয়ে যান আব্বাস।

ওই সময় গ্রামের জনা তিরিশেক ফুটবলপ্রেমী মিলে খেলা দেখার আয়োজন করেন। প্রতিবেশীদের উঠানে বসে সাদা-কালো টেলিভিশনের সামনে বসে খেলা দেখেন। ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমক দেখায় ক্যামেরুন। ঐতিহাসিক সেই ম্যাচটি টেলিভিশনে দেখেছিলেন আব্বাস।

আব্বাস বলেন, আর্জেন্টিনা ভালো একটি দল ছিলো। কিন্তু শক্তিশালী ক্যামেরুন সেদিন আর্জেন্টিনার প্রতিটি খেলোয়াড়কে সামাল দেয়। আর্জেন্টিনা দলে ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ক্যানিজিয়া ও হোর্হে বুরুচাগার মতো দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন।

ক্যামেরুনের সঙ্গে ম্যাচটিতে আর্জেন্টিনা হেরে গেলেও ম্যারাডোনার খেলা দেখে মুগ্ধ হন কিশোর আব্বাস। তিনি বলেন, ‘ম্যারাডোনার কারণেই আমি ফুটবলের প্রেমে পড়ে যাই। ম্যারাডোনার পাসিং, ড্রিবলিং এবং বল মাথায় নেওয়ার দক্ষতা ছিলো চেয়ে থাকার মতো।’

স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর একটি অটোরিকশার গ্যারেজে চাকরি নেন আব্বাস। কিছুদিন পর বালু তোলার কাজে যোগ দেন তিনি। কাজের পাশাপাশি প্রতিদিন সংবাদপত্রের খেলাধুলা পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। মাতৃভাষা মালায়ালাম হলেও স্পোর্টসস্টার নামের খেলাধুলা বিষয়ক একটি ম্যাগাজিন পড়তে পড়তে ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করে ফেলেন।

নিয়মিত প্রিমিয়ার লিগের খেলাও দেখতেন আব্বাস। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখে দলটির ভক্ত বনে যান তিনি। একইসঙ্গে ব্রাজিলের জাতীয় দলকেও যথেষ্ট সম্মান করতেন। বড় দলের পাশাপাশি ছোট দল ও তাদের কিছু কিছু খেলোয়াড়দেরও সম্মান করতেন। আব্বাস বলেন, ‘ক্ষিপ্রতার কারণে আফ্রিকান ফুটবলারদের আমার প্রচন্ড ভালো লাগে। তাঁদের নেচে নেচে জয় উদ্‌যাপনও দারুন।’

বিয়ের পর ভাগ্য ফেরাতে নিজ জেলার আরও অনেকের সঙ্গে সৌদি আরবে পাড়ি জমান আব্বাস। সেখানে ২০০৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত একটি সুপারমার্কেটে কাজ করেছেন। এরপর দেশে ফিরে আবার বালু তোলার কাজে যোগ দেন। ২০১৭ সালে আবারও জীবিকার টানে কাতারে পাড়ি জমান আব্বাস।

আব্বাসের পরিবারও ফুটবল ভক্ত। এই ভক্ততালিকায় আছেন তাঁর তিন ভাই-ও। তবে মা তেমন একটা খেলা দেখেন না । আব্বাসের স্ত্রীর নাকি ফুটবলে প্রচণ্ড আগ্রহ। তাঁর স্ত্রী ও তিন সন্তান কেরালায় থাকেন। বছরে একবার তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে দেশে যান তিনি।

তবে ফুটবলকে এতো ভালোবেসেও মন খারাপ ছিল আব্বাসের। কারণ, বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচের টিকিট কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতা তাঁর ছিলো না। এমন অবস্থায় তাঁর পাশে দাঁড়ান রেস্তোরাঁর একজন নিয়মিত ক্রেতা। আব্বাসকে আর্জেন্টিনা বনাম পোল্যান্ড ম্যাচের একটি টিকিট দেন তিনি। ফলে মাঠে বসে বিশ্বকাপের খেলা দেখার স্বপ্নও পূরণ হয়েছে তাঁর।