পৃথিবীর অর্ধেক মানুষই গেম খেলছে
গেম খেলা ত্রিশুর রুকমনির দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ৯২ বছর বয়সী এই নারী কিছু কিছু সময় টানা ১০ মিনিট গেম খেলেন। অনেক সময় গেম খেলতে খেলতে আরও বেশি সময় পেরিয়ে যায়। রুকমনি বলেন, হাতে যখন অন্য কোনো কাজ থাকে না, তখন গেম খেলে সময় কাটাই। গেম খেলার মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতার রোমাঞ্চ কাজ করে। তবে এর সামাজিক অভিজ্ঞতাও একেবারে কম নয়। ভারতের ব্যাঙ্গালুরে বসে রুকমনি অনলাইনে ভিডিও গেম খেলার স্কোর জানিয়ে দেন পৃথিবীর আরেক প্রান্তে থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের।
পকেটের অর্থ খরচ করে তরুণ ও কিশোরদের ভিডিও গেম খেলার অভ্যাস অনেক পুরোনো। কিন্তু এখন ভিডিও গেমের ব্যবসার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রুকমনিই সেই পার্থক্য দেখিয়ে দিচ্ছেন। তিনি যে গেম খেলছেন, তাতে জাপানি গেম কনসোল লাগছে না। তিনি খেলছেন মোবাইল ও ট্যাবলেট পিসিতেই। আর মোবাইল ও ট্যাবের অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করেছে দুই মার্কিন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান অ্যাপল ও গুগল।
রুকমনির প্রিয় গেমের নাম ‘ওয়ার্ডলি’। এই গেম বিনা মূল্যেই খেলা যায়। এই গেমের প্রকাশক কিন্তু কোনো গেমসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়। এটি প্রকাশ করেছে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্ক টাইমস। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক গেমারের মতোই রুকমনির বাস এশিয়া অঞ্চলে। বয়সে রুকমনি অনেক গেমারকেই ছাড়িয়ে যাবেন। তবে বয়সের হিসাবে আরেক গেমার তাঁর স্বামীর চেয়ে বয়সে এক বছর কম।
ধনী দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ গেম খেলে। তাদের অর্ধেকই আবার নারী। গেম খেলা তরুণদের শখ মনে করা হলেও বয়স্ক ব্যক্তিরাও এখন দ্রুত গেম খেলার অভ্যাস গড়ে তুলছেন।
গত বছর বিশ্বের ৩২০ কোটি মানুষ ভিডিও গেম খেলেছে। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতি ১০ ব্যক্তির মধ্যে ৪ জনই ভিডিও গেম খেলেছে। এক বছরে গেম খেলা মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি বেড়েছে। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় ভিডিও গেমার ব্যাপক বেড়ে যায়। ধনী দেশগুলোর দুই–তৃতীয়াংশ মানুষ গেম খেলে। তাদের অর্ধেকই আবার নারী। গেম খেলা তরুণদের শখ মনে করা হলেও বয়স্ক ব্যক্তিরাও এখন দ্রুত গেম খেলার অভ্যাস গড়ে তুলছেন। যুক্তরাজ্যে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণ–তরুণীদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই গেম খেলেন। অন্যদিকে ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের অর্ধেকই গেম খেলা রপ্ত করছেন।
বিনোদন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মিডিয়া রিসার্চের কর্মকর্তা ক্যারোল সেভেরিন বলেন, বিশ্বজুড়ে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের তুলনায় কনসোলের মালিক ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা বেশি। তাই বলা চলে, গেম খেলা এখন আর কেবল তরুণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
মূলত স্মার্টফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির পর থেকে গেম খেলা বেড়েছে। এখন প্রায় সবার পকেটেই শক্তিশালী গেমিং যন্ত্র হয়ে উঠেছে এই স্মার্টফোন। অ্যাপ স্টোরে রয়েছে হাজার হাজার গেম। এসব গেমের অধিকাংশ বিনা মূল্যে খেলা যায়। তবে একবার গেম খেলা শুরু করলে সেটি অনেক সময় ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়ায়। ডিজিটাল গেমগুলোয় গ্রাহকদের খরচের প্রায় অর্ধেকেই চলে যায় মোবাইল অ্যাপগুলোর পেছনে।
তথ্য বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ওমডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, এ বছর সব মিলিয়ে গেমের বাজার দাঁড়াবে ১৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই বাজারে গেম খেলতে যে হার্ডওয়্যার ও সরঞ্জাম লাগে, সেগুলো হিসাবে ধরা হয়নি। এ ছাড়া গেমের মধ্যে থাকা বিজ্ঞাপনের হিসাবও এর বাইরে। গেমের মধ্যে যে বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়, তার বাজারও ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
বিশ্বজুড়ে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যক্তিদের তুলনায় কনসোলের মালিক ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা বেশি। তাই বলা চলে, গেম খেলা এখন আর কেবল তরুণদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
গেমের বাজার যেভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছে, তাতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও এই ব্যবসায় ঝুঁকছে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ১০টি কোম্পানির মধ্যে ৭টির গেমিং খাতে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়োগও করেছে। ২০০১ সালে এক্সবক্স কনসোল এনেছিল মাইক্রোসফট। গত বছর প্রতিষ্ঠানটি ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গেম নির্মাতা অ্যাকটিভিশন ব্লিজার্ডকে কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অ্যান্টি ট্রাস্ট নিয়ন্ত্রকেরা বাধা না তৈরি করলে এটিই হবে প্রযুক্তি খাতের অন্যতম বড় অধিগ্রহণের ঘটনা।
বর্তমানে প্রযুক্তি বিশ্বে অ্যাপল ও গুগল গেম বিতরণের শীর্ষ দুই প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে থাকা দুটি প্রধান অ্যাপ স্টোরের কল্যাণে তারা এই অবস্থানে। গুগলের প্লে স্টোর ও অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরে যত অ্যাপ বিক্রি হয়, তার ৬০ শতাংশই গেমিং অ্যাপ। অনলাইন জায়ান্ট অ্যামাজন ও চিপনির্মাতা এনভিডিয়া মিলে অনলাইনে গেম স্ট্রিমিং করছে। চীনের টেনসেন্ট নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে গেম। তারা এখন চীনের বাইরেও গেমারদের টানছে। মেটা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির দিকে নিয়ে গেছে। এটি মূলত গেমের জন্যই বেশি ব্যবহৃত হয়।
অবশ্য গত বছর অস্বাভাবিকভাবে গেমের পেছনে খরচ কমিয়ে দিয়েছে গেমাররা। মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকেই সংসারের বাজেট কমিয়েছেন। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের সময়ের লকডাউন শেষ হয়েছে। মানুষ এখন তাঁদের স্বাভাবিক কর্মক্ষেত্রে ফিরেছেন। মোবাইল বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অ্যাপলের কট্টর নীতির কারণে গেম নির্মাতারা নতুন গ্রাহক পাচ্ছেন না। এ ছাড়া সরবরাহব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে গেমিং কনসোল সহজলভ্য নয়। এ বছর গেমের প্রবৃদ্ধি আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিনোদন খাতের অন্যান্য মাধ্যমের চেয়ে মানুষকে দ্রুত আকর্ষণ করে গেম। তাই ইতিমধ্যে গেমের মূল্য বই, গান বা চলচ্চিত্রকেও ছাড়িয়ে গেছে। এখন বৃহত্তম মিডিয়া ব্যবসা হিসেবে টেলিভিশনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হচ্ছে গেমের। নেটফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং সেবার চেয়েও গ্রাহক এখন ডিজিটাল গেমে বেশি অর্থ ব্যয় করছেন। শিগগিরই এ খাতের ব্যয় পে-টিভি চ্যানেলগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। তবে সব মিলিয়ে এখনো টিভির আয় ডিজিটাল গেমের চেয়ে বেশি। কিন্তু দ্রুত এই পার্থক্য কমে আসছে।
২০২১ সালে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিলোইটি একটি সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের আগের প্রজন্ম বাড়িতে প্রিয় বিনোদন মাধ্যম হিসেবে টিভি ও চলচ্চিত্রকে বেছে নিলেও জেড প্রজন্ম (যাঁদের বয়স ২৫ বছরের কম) গেম বেশি পছন্দ করে। ডিলোইটি বলেছে, ভিডিও বিনোদন এখন যে আধিপত্য ধরে রেখেছে, তা দ্রুত বদলে যেতে পারে।
ডিলোইটির প্রতিবেদনে বলা হয়, টেলিভিশনের মতোই গেম যেহেতু গণমাধ্যম হিসেবে রূপ নিতে শুরু করেছে, এর উন্নয়ন অন্য গণমাধ্যমকে অনুকরণ করবে। বিতরণের কথা ধরলে দেখা যাবে, হলিউড এখনো স্ট্রিমিং ও সাবস্ক্রিপশনের মডেলের বিপ্লবে পরিণত হতে পারেনি। তাই নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গেমিংয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিপ্লব আনা যায় কি না, সেটা নিয়ে পরীক্ষা চালাবে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রের মতো গেম তৈরির পথে হাঁটতে পারেন নির্মাতারা। ব্লকবাস্টার মুভির মতোই কোনো গেমের নাম আগে জনপ্রিয় করে তুলে গেমিং স্টুডিওগুলো চলচ্চিত্র প্রোডাকশন হাউসগুলোর অনুকরণ করতে পারে।
টিকটক ও ইউটিউব এখন ব্যবহারকারীর কাছ থেকে কনটেন্ট নিয়ে কোটি কোটি ডলারের শিল্পে পরিণত হয়েছে। এটি এখন পেশাদার গণমাধ্যমেরও নজর কেড়েছে। রোবোলক্স ও মাইনক্রাফটের মতো অ্যাপ এখন ব্যবহারকারীদের কনটেন্ট গেমে কাজে লাগানোর উপায় খুঁজছে।
চলচ্চিত্র যেমন বিংশ শতাব্দীতে সমাজ গঠনে সাহায্য করেছিল, তেমনি একবিংশ শতাব্দীতে এসে সংস্কৃতির ওপর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ফেলছে গেম। একটা সময় হলিউডের চলচ্চিত্রগুলো যেমন তরুণদের মনে গেঁথে যেত, গেমের সাংস্কৃতিক প্রভাব এখন তরুণদের কল্পনাকে দখল করছে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, চলচ্চিত্র যেমন দীর্ঘ সময় একচেটিয়া মার্কিন আধিপত্য দেখিয়েছিল, ভিডিও গেম তার থেকে অনেক দূরে। চীনের তৈরি টিকটক সেই শক্তি ইতিমধ্যে দেখিয়েছে। মার্কিন আইনপ্রণেতারা এখন এটি বন্ধ করতে চান।
কনসোল থেকে ফোন, ফোর্টনাইট থেকে ওয়ার্ডলি এসব বিবেচনায় নিলে গেমিংকে সত্যিকারের গণমাধ্যম বলতে হবে। কারণ, এতে সব ধরনের সামাজিক অনুষঙ্গ বিদ্যমান রয়েছে।