প্রয়াত মায়ের শোক কাটাতে যেভাবে এআইয়ের ব্যবহার করলেন তিনি

শিরিন মালাসছবি: ইউটিউব থেকে সংগৃহীত

মায়ের মৃত্যুর চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও শোক কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না জার্মান অভিনেত্রী শিরিন মালাস। কী করলে মাকে হারানোর এ বেদনা কমবে, সেটাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবস্থা হাতে পান, যা তাঁকে কিছুটা হলেও মাকে হারানোর বেদনা ভুলিয়ে দিয়েছে।

শিরিন বলেন, ‘আপনি যখন মানসিকভাবে দুর্বল অবস্থায় থাকেন, তখন বাছবিচার না করে যেকোনো কিছুই গ্রহণ করে ফেলবেন।’

শিরিন মালাসের জন্ম সিরিয়ায়। ২০১৫ সালে সিরিয়া ছেড়ে জার্মানিতে চলে যান তিনি। এতে মা নাজাহর সঙ্গে এই অভিনেত্রীর বিচ্ছেদ তৈরি হয়। বার্লিনে প্রথম সন্তান ইশতারের জন্মের পর শিরিন সাধ্যমতো চেষ্টা করছিলেন মা যেন তাঁর সন্তানকে দেখতে পান, তাঁদের আবারও দেখা হয়। তবে সে সুযোগ আর হয়নি। ২০১৮ সালে ৮২ বছর বয়সে কিডনি বিকল হয়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমান মা নাজাহ।

মায়ের সম্পর্কে শিরিন বলেন, ‘তিনি আমার জীবনের পথপ্রদর্শক ছিলেন। কীভাবে নিজেকে ভালোবাসতে হয়, তা তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন।’

শিরিন আরও বলেন, ‘আমি খুব করে চাইছিলাম আমার মেয়ের সঙ্গে মায়ের দেখা হোক। শেষবারের মতো একত্র হতে চেয়েছিলাম।’

মাকে হারিয়ে ফেলার এই বেদনাকে অসহনীয় বলে উল্লেখ করেছেন শিরিন।

চার বছর ধরে শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে গেছেন শিরিন। এরপর ‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’ নামের এআই টুলটির খোঁজ পান। এই এআই টুলের নেপথ্যের মানুষদের দাবি, এটি মৃত মানুষদের জীবদ্দশার আচরণ ও কথাবার্তাকে অনুকরণ করতে পারে।

‘প্রজেক্ট ডিসেম্বর’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অনলাইনে একটি ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে মৃত প্রিয়জনের বয়স, তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক কী ছিল এবং ওই মৃত ব্যক্তির একটি উদ্ধৃতিসহ বিভিন্ন তথ্য পূরণ করতে হয়।

এরপর এসব তথ্য চ্যাটজিপিটিতে ব্যবহৃত ভাষা মডেলের প্রাথমিক সংস্করণ ব্যবহার করে, এমন একটি এআই চ্যাটবটে যুক্ত করা হয়। মৃত স্বজনকে নিয়ে ব্যবহারকারীর স্মৃতিতে যেসব তথ্য থাকে, সেগুলোর ভিত্তিতে ওই মৃত স্বজনের প্রোফাইল তৈরি করা হয়।

এই এআই ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের অর্থ গুনতে হয়। ১০ ডলার খরচ করলে ব্যবহারকারীরা চ্যাটবটে প্রায় এক ঘণ্টা মেসেজ আদান-প্রদান করতে পারেন।

এআই টুলটি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা জানিয়ে শিরিন বলেন, ‘কিছু সময় আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তবেই বলে মনে হচ্ছিল। আবার কিছু সময় মনে হয়েছে, এভাবে তো যে কেউই উত্তর দিতে পারে।’

মায়ের মতো করেই চ্যাটবটে শিরিনকে ডাকনামে সম্বোধন করা হয়েছে। অনলাইন ফরমে দেওয়া তথ্যে শিরিন এই তথ্য যুক্ত করেছিলেন। মায়ের মতো করেই চ্যাটবটে তিনি ভালোভাবে খাচ্ছেন কি না, তাঁর খোঁজখবর জানতে চাওয়া হয়েছে। এমনকি শিরিনকে এটাও বলা হয়েছে যে মা তাঁকে দেখছেন।

প্রজেক্ট ডিসেম্বরের ব্যবহারকারীর সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এর প্রতিষ্ঠাতা জ্যাসন রোহরার বলেন, সাধারণত আকস্মিকভাবে প্রিয়জন হারানো মানুষেরা এই টুল ব্যবহার করে থাকেন।

জ্যাসন জানান, বেশির ভাগ মানুষই মৃত প্রিয়জনের সঙ্গে শেষ আলাপচারিতার ইচ্ছা পূরণে টুলটি ব্যবহার করেন। তাঁরা সাধারণত একবার এটি ব্যবহার করে চলে যান। তবে কিছু গ্রাহককে বারবারই এ টুল ব্যবহার করতে দেখা গেছে। জ্যাসন মনে করেন, এসব মানুষ চান, এভাবে প্রিয়জনেরা তাঁদের মধ্যে বেঁচে থাকুন।

জ্যাসনের দাবি, মানুষ এ টুলে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন কিংবা এখান থেকে তাঁদের বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ ধরনের এআই টুল ব্যবহার করা হলে শোকের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে।

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাইকোথেরাপি স্বীকৃত থেরাপিস্ট বিলি ডুনলেভি বলেন, ‘শোক কাটিয়ে ওঠার যেসব থেরাপি আছে, তাতে মৃত ব্যক্তির অনুপস্থিতি বুঝতে শেখানো হয়। নতুন বাস্তবতা ও নতুন স্বাভাবিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বলা হয়। এ প্রক্রিয়াগুলো বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’

মৃতদের জীবদ্দশার আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে অনুকরণ করতে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিমালা হয়নি।