ফিরে দেখা
জেনারেল নরিয়েগাকে ধরতে দূতাবাসের বাইরে উচ্চ শব্দে গান বাজাতে থাকে মার্কিন বাহিনী
পানামার স্বৈরশাসক জেনারেল ম্যানুয়েল আন্তনিও নরিয়েগাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পানামায় ‘জাস্ট কজ’ নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ এই নরিয়েগাই সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে থাকার সময় সিআইএর গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন। শুধু নিজ দেশের গোপন তথ্য নয়, তিনি লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের অন্যান্য দেশের গোপন তথ্যও ওয়াশিংটনে পাচার করতেন। এভাবে মার্কিন কর্তাব্যক্তিদের সুনজরে থেকে ধীরে ধীরে দাম্ভিক এক স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন নরিয়েগা, যুদ্ধ ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে।
অভিযান শুরু হয় একযোগে—আকাশ, ভূমি ও সমুদ্র থেকে। রাতের আঁধারে হাজার হাজার মার্কিন সেনা ঢুকে পড়েন পানামায়। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপারেশন জাস্ট কজ’। লাতিন আমেরিকার ছোট্ট দেশ পানামার রাজধানী পানামা সিটি রাতারাতি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।
দিনটি ছিল ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর। তত দিনে নিজেদের এক সময়ের বিশ্বস্ত গুপ্তচর, পরে পানামার স্বৈরশাসক জেনারেল ম্যানুয়েল আন্তনিও নরিয়েগার সঙ্গে ওয়াশিংটনের শত্রুতা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে, যেখান থেকে আর ফেরা সম্ভব ছিল না।
সিআইএ গুপ্তচর
১৯৭০–এর দশকের প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) গুপ্তচর হিসেবে কাজ করতেন নরিয়েগা। তিনি অর্থের বিনিময়ে সিআইএর কাছে তথ্য পাচার করতেন।
নরিয়েগার সহায়তায় ওয়াশিংটন পানামায় গোপন এক নজরদারির কেন্দ্র গড়ে তুলেছিল। তিনি লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কান হয়ে উঠেছিলেন। পানামাকে ব্যবহার করে এল সালভাদর ও নিকারাগুয়ায় যুক্তরাষ্ট্রপন্থী সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে অর্থ-অস্ত্রও পাঠাত ওয়াশিংটন।
সে সময় ওয়াশিংটনের সঙ্গে নরিয়েগার দহরমমহরম সম্পর্ক। পানামার তৎকালীন সামরিক শাসক ওমর তোরিজোসেরও তিনি প্রিয়পাত্র। তোরিজোস তাঁকে পানামার সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করেন।
চতুর নরিয়েগা হাতে পাওয়া সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর তথ্যের জালে পানামা ও মার্কিন কর্তাদের প্রভাবিত করে নিজের স্বার্থে তাদের ব্যবহার করতে থাকেন।
১৯৮১ সালে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় মারা যান তোরিজোস। দুই বছর পর পানামার ক্ষমতার লাগাম নিজের হাতে তুলে নেন নেরিয়েগা। তত দিনে পাবলো এসকোবার মতো কলম্বিয়ার মাদক সম্রাটদের সঙ্গে মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি।
কলম্বিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন পাচার হতো। মাদক বিক্রি থেকে পাওয়া বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ পানামার ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে বৈধ করা হতো। এর বিনিময়ে নরিয়েগার পকেটে যেত লাখ লাখ ডলার।
১৯৮৮ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র নরিয়েগার এ অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য পেতে শুরু করে। কিন্তু শুরুতে নিজেদের স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র নরিয়েগার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
শীতল যুদ্ধের সময়ে পানামাকে মধ্য আমেরিকা অঞ্চলে বামপন্থী বিদ্রোহের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ জন্য নরিয়েগাকে ওয়াশিংটনের প্রয়োজন ছিল।
নরিয়েগা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায় ১৯৮৫ সালে, যখন নরিয়েগা পানামার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলা আরদিতো বারলেত্তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। বারলেত্তা ছিলেন পানামায় ১৬ বছরের মধ্যে প্রথমবার ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।
বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত নৌবাণিজ্য পথ পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পানামার হাতে তুলে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার মধ্যে একটি চুক্তি হয়। ওই চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল, সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে পানামাকে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে। শর্তপূরণে ১৯৮৪ সালে দেশটিতে ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল।
নরিয়েগাই সেবার প্রভাব খাটিয়ে ভোটে জিতিয়েছিলেন বারলেত্তাকে। রাষ্ট্রপ্রধান হলেও আদতে তিনি ছিলেন সেনাপ্রধানের হাতের পুতুল। বারলেত্তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ ছিল না। তার ওপর একের পর এক মাদক পাচার–কাণ্ডে বারবার নরিয়েগার নাম আসতে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্যের বাঁধ আলগা হতে শুরু করে।
পরের কয়েক বছরে পানামার শাসনক্ষমতা মূলত সেনাপ্রধান নরিয়েগার হাতেই কুক্ষিগত ছিল।
মার্কিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় যে কারণে
দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে পানামা খাল অঞ্চলে অবস্থান করা মার্কিন সেনাদের সঙ্গে নরিয়েগার পানামা ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এর মধ্যে ১৯৮৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর পানামার জাতীয় পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবে পানামায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘোষণা করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন প্রতিহত করতে পানামা যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে।
একই দিন নরিয়েগা নিজেকে দেশের সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করেন এবং দম্ভভরে প্রকাশ্যেই বলেন, ‘একদিন আমাদের শত্রুদের মৃতদেহ পানামা খাল দিয়ে ভেসে যাবে এবং পানামার মানুষ পুরো জলপথের নিয়ন্ত্রণ নেবে।’
ঠিক তার পরদিন এমন এক ঘটনা ঘটে, যা ওয়াশিংটনের জন্য হজম করা অসম্ভব ছিল। দিনটি ছিল শনিবার। মার্কিন চার সেনা কর্মকর্তা ছুটির দিন রাতের বেলা ঘুরতে বের হয়েছিলেন। পথ ভুল করে তাঁদের গাড়ি পিডিএফের তল্লাশিচৌকির সামনে গিয়ে পড়ে। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১১ পেরিয়ে ১০ মিনিটে।
পিডিএফের সেনারা মার্কিন সেনাদের গাড়ির বাইরে আসতে বলেন, কিন্তু মার্কিন সেনারা সেটা করতে অস্বীকৃতি জানান এবং দ্রুত গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করেন। এরপরই পিডিএফের রক্ষীরা গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালান। গাড়িটি দ্রুতবেগে ঘটনাস্থলত্যাগ করলেও অন্য একটি পিডিএফ তল্লাশিচৌকির সামনে পড়ে এবং সেখানেও গুলি চলে।
গাড়িতে থাকা মার্কিন তিন সেনা আহত হন। তাঁদের মধ্যে মেরিন সেনা ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট রবার্ট পাজ গুরুতর আহত অবস্থায় সামরিক হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় মার্কিন সেনাবাহিনীতে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনা তদন্তে সেনা কর্মকর্তারা সে রাতেই পানামা উড়ে আসেন।
খবর চলে যায় আরও ওপর মহলে এবং ধাপে ধাপে পৌঁছায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের কানে।
পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হোয়াইট হাউসে উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন প্রেসিডেন্ট বুশ, সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও সামরিক কর্মকর্তারা।
অভিযানের প্রস্তুতি
হোয়াইট হাউসে বৈঠকে পানামায় বসবাস করা প্রায় ৩৫ হাজার মার্কিন নাগরিকের জীবন রক্ষা, পানামা খাল ও সেটি ঘিরে ১৪২টি মার্কিন প্রতিরক্ষা স্থাপনার অখণ্ডতা রক্ষা, পানামায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পিডিএফকে নিশ্চিহ্ন করা এবং নরিয়েগাকে বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
শুরুতে সরাসরি সামরিক অভিযানে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না প্রেসিডেন্ট বুশ। তিনি যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে ব্যর্থ না হওয়ার নিশ্চয়তা চাইছিলেন।
অভিযান কত বড় হবে, কত হতাহত হতে পারে, কতটা ক্ষতি হবে এবং পুরো লাতিন আমেরিকায় কূটনৈতিক প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়েও তিনি চিন্তিত ছিলেন।
সেনা কর্মকর্তারা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন এবং প্রেসিডেন্ট বুশ অভিযানের অনুমতি দিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে বলেন। কখন হামলা শুরু হবে, সেটিও ঠিক করা হয়। ওই সময়ের নাম দেওয়া হয় ‘এইচ-আওয়ার’।
১৮ ডিসেম্বর সোমবার থেকে একাধিক মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে সামরিক অভিযানের পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।
১৯ ডিসেম্বর মার্কিন সেনাদের আকাশপথে পানামা পাঠানো শুরু হয়। এর আগে প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করেন সে সময়ের ‘চেয়ারম্যান অব দ্য জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ’ কলিন পাওয়েল।
ওয়াশিংটনের ফোর্ট লুই সেনাঘাঁটির রেঞ্জারদের একটি দল লসন আর্মি এয়ারফিল্ড থেকে ১৩টি সি-১৩০ সামরিক উড়োজাহাজে করে পানামা রওনা হয়।
জর্জিয়ার ফোর্ট স্টুয়ার্ট সেনাঘাঁটির রেঞ্জাররা হান্টার আর্মি এয়ারফিল্ড থেকে ১২টি সি-১৩০ উড়োজাহাজে চেপে, তারপর চার্লস্টন এয়ারফোর্স বেস থেকে ৩০টি সি-১৪১ ‘হেভি ড্রপ’ কার্গো উড়োজাহাজও উড়াল দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ২০০টির বেশি উড়োজাহাজ পানামা অভিযানে অংশ নিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে ৮০টি সি-১৪১, ২২ থেকে ২৫টি সি-১৩০, ১১টি সি-৫১ স্ট্র্যাটেজিক এয়ার কমান্ড ছিল।
এ ছাড়া ১৬টি এফ-১৫ ও ৪টি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের কি ইস্ট থেকে ক্যারিবীয় উপকূলে ইউকাটান উপদ্বীপ ও কিউবার মধ্যে যুদ্ধকালীন টহল দিয়েছিল।
আকাশপথে মার্কিন সেনাদের পানামা পাঠানোর কাজে কিউবা বা নিকারাগুয়া থেকে যেন কেউ বিঘ্ন ঘটাতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে সেগুলোকে মোতায়েন করা হয়েছিল।
আটলান্টিক ফ্লিটের নৌ হেলিকপ্টারগুলো অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তার জন্য প্রস্তুত ছিল।
হঠাৎ ১৯ ডিসেম্বর বিকেল ও সন্ধ্যায় কেন যুক্তরাষ্ট্রের এত সামরিক উড়োজাহাজ পানামায় যাতায়াত করছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছিল। ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সরকার সন্দেহ ও উদ্বেগের চোখে বিষয়টির ওপর নজর রাখছিল।
পেন্টাগন অবশ্য মার্কিন উড়োজাহাজগুলো পানামায় যাচ্ছে কি না, সে তথ্য দিতেই রাজি ছিল না। শুধু বলেছিল, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি হিসেবে সেনা মহড়া চলছে।
‘অপারেশন জাস্ট কজ’
পানামায় নরিয়েগার হাতে পিডিএফের প্রায় ১২ হাজার ৮০০ সদস্য ছিল। কিন্তু আদতে যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত যোদ্ধা ছিলেন মাত্র চার হাজার। অন্যরা ন্যাশনাল গার্ড, পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তা।
আর পানামায় আগে থেকেই প্রায় ১৩ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছিলেন। তাঁরা পানামা খালের নিরাপত্তার দায়িত্বে সেখানে মোতায়েন ছিলেন। অভিযানের অংশ হিসেবে আরও সাত হাজার মার্কিন সেনাকে আকাশপথে পানামায় নিয়ে আসা হয়।
এইচ-আওয়ারের জন্য সেনারা প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, সংকেত পেলেই পানামা সিটিতে পিডিএফের অবস্থান লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
পরের কয়েক দিনে আরও প্রায় সাত হাজার মার্কিন সেনা পানামায় আসেন। শেষ ধাপে আসা সেনাসহ পানামায় ‘জাস্ট কজ’ অভিযানে প্রায় ২৭ হাজার মার্কিন সেনা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ২২ হাজার সেনা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন।
প্রাথমিক পরিকল্পনায় মার্কিন বাহিনী হামলার সময় হিসেবে ২০ ডিসেম্বর রাত একটা ঠিক করেছিল। তারা এ সময়ের নাম দিয়েছিল এইচ-আওয়ার।
কিন্তু ১৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর পিডিএফের অস্বাভাবিক তৎপরতার কারণে মার্কিন বাহিনী এইচ-আওয়ার বা অভিযান শুরুর সময় ১৫ মিনিট এগিয়ে আনে।
রাতের আকাশ ভেদ করে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা শুরু করে মার্কিন বাহিনী। পিডিএফের দুটি রাইফেল কোম্পানি ব্যারাকে দুটি ২০০০ পাউন্ড ওজনের বোমা ফেলা হয়। অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে নিখুঁত নিশানায় ‘হেলফায়ার’ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
রাতভর পানামা সিটিজুড়ে লড়াই চলে। মার্কিন বাহিনীর সামনে পিডিএফ তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।
মার্কিন বাহিনী ছাড়াও ‘ডিগনিটি ব্যাটালিয়ন’ নামে স্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গড়া একটি দল শহরজুড়ে দাপিয়ে বেড়ায়। যদিও নরিয়েগার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার চেয়ে লুটপাট ও সাধারণ মানুষদের আতঙ্কিত করাতেই তাদের আগ্রহ বেশি ছিল।
প্রেসিডেন্ট বুশের ভাষণ
মুহুর্মুহু আক্রমণে পানামা সিটি যখন কেঁপে কেঁপে উঠছে, ঘুমন্ত বাসিন্দারা যখন সেই শব্দে জেগে উঠে নিজেদের যুদ্ধক্ষেত্রে আবিষ্কার করছেন এবং প্রাণ বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে ছুটছেন, ঠিক তখন হাজার কিলোমিটার দূরের এক দেশে নির্ঘুম এক প্রেসিডেন্ট নিজেকে প্রস্তুত করছেন।
একটি সার্বভৌম দেশে হঠাৎ সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জনগণের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে বুশকে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে জাস্ট কজ অভিযানের ন্যায্যতা তাঁকে প্রমাণ করতে হবে। ভাষণ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত তাঁর কর্মকর্তারা।
২০ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সাতটায় টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায় প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে, দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেবেন তিনি।
বুশ ভাষণ শুরু করেন, প্রিয় দেশবাসী, গত রাতে আমি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে পানামায় অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছি…প্রায় দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলো একত্র হয়ে পানামার সংকট সমাধানে কাজ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল মার্কিনদের জীবন রক্ষা করা, পানামায় গণতন্ত্র রক্ষা করা, মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং পানামা খাল চুক্তির অখণ্ডতা রক্ষা করা।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ বলতে থাকেন, কূটনীতি ও আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধান করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পানামার স্বৈরশাসক জেনারেল ম্যানুয়েল নরিয়েগা সব প্রচেষ্টাই প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি একজন অভিযুক্ত মাদক কারবারি।
এরপর প্রেসিডেন্ট বুশ তাঁর ভাষণে পানামায় শুক্র ও শনিবার ঘটা ঘটনার বর্ণনা দেন।
প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন, গত শুক্রবার নরিয়েগা সামরিক অভ্যুত্থান ঘোষণা করেন এবং তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছে ঘোষণা দিয়ে পানামায় থাকা মার্কিনদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দেন।
ঠিক এর পরদিন তাঁর কমান্ডে থাকা বাহিনী নিরস্ত্র একজন মার্কিন সেনাকে গুলি করে হত্যা করে, আরেকজনকে আহত করেছে, ৪৩ জনকে আটক করেছে এবং তৃতীয় একজন মার্কিন সেনাকে নির্মমভাবে মারধর করেছে। তারপর তাঁর স্ত্রীকে নিষ্ঠুরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ ও যৌন নির্যাতনের হুমকি দেয়।
বুশ বলেন, যথেষ্ট হয়েছে। জেনারেল নরিয়েগার বেপরোয়া হুমকি এবং মার্কিনদের ওপর আক্রমণ পানামায় থাকা ৩৫ হাজার মার্কিনের জন্য তাৎক্ষণিক বিপদ সৃষ্টি করেছিল।
প্রেসিডেন্ট বুশ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মার্কিনদের জীবন রক্ষা করা। এ কারণেই আমি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি, পানামায় থাকা মার্কিনদের জীবন রক্ষা করতে এবং জেনারেল নরিয়েগাকে ন্যায়বিচারের মুখোমুখি করতে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসতে।’
হতাহতের সংখ্যা
মার্কিন বাহিনীর সামনে মাত্র চার দিন টিকতে পেরেছিল নরিয়েগার পিডিএফ। ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে পানামার অধিকাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে মার্কিন বাহিনীর হাতে।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পানামায় মার্কিন সামরিক অভিযানে দেশটির ৫১৪ জন সেনা ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫০ থেকে ২০০ জন পিডিএফের সেনা, অন্যরা বেসামরিক নাগরিক। তবে স্থানীয় কয়েকটি দল দাবি করেছিল, নিহতের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের ২৩ সেনা প্রাণ হারান।
নরিয়েগাকে আটক করতে অভিনব কৌশল
মার্কিন সেনারা পানামায় অভিযান শুরুর পরপরই নিজের বিপদ বুঝে যান নরিয়েগা। তাঁকে গ্রেপ্তার করতেই যে যুক্তরাষ্ট্রের এত আয়োজন। গ্রেপ্তার এড়াতে নরিয়েগা পানামা সিটির ভ্যাটিকান কূটনৈতিক মিশনে আশ্রয় নেন। তিনি সেখানে নারী সেজে লুকিয়ে ছিলেন।
নরিয়েগাকে দূতাবাস থেকে বের করে আনতে মার্কিন বাহিনী অভিনব কৌশল গ্রহণ করে। যেহেতু ভ্যাটিকানের কূটনৈতিক মিশন, তাই মার্কিন বাহিনী সেখানে জোর করে প্রবেশ করতে পারছে না। তারা মিশনের বাইরে অবস্থান নেয়।
নরিয়েগার বিরুদ্ধে অস্ত্রের লড়াইয়ের পর মার্কিন বাহিনী শুরু করে এক মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। তারা মিশনের বাইরে উচ্চ শব্দে রক মিউজিক বাজাতে শুরুর করে।
দিনরাত ২৪ ঘণ্টা উচ্চ শব্দে দ্য ক্ল্যাস, ভ্যান হ্যালেন ও ইউ২–এর মতো সেই সময়ের জনপ্রিয় সব হার্ড রক ব্যান্ডের গান বাজতে থাকে।
মানসিক এ অত্যাচারের কাছে অবশেষে হার মানেন নরিয়েগা। তিনি ভ্যাটিকান মিশন থেকে বেরিয়ে আসেন। ৩ জানুয়ারি ১৯৯০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। নরিয়েগা ১১ দিন ভ্যাটিকান মিশনে লুকিয়ে ছিলেন।
দুই সপ্তাহে সফলভাবে পানামায় জাস্ট কজ অভিযান শেষ করে যুক্তরাষ্ট্র।
গ্রেপ্তারের পর যুক্তরাষ্ট্রের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা নরিয়েগাকে মায়ামিতে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়।
সে সময় নরিয়েগা অভিযোগ করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে নিয়ে খেলা করেছে। তাঁকে হাতমোজার মতো ব্যবহার করেছে।
বিচারে মাদক পাচার, সংঘবদ্ধ অপরাধ–কাণ্ডে জড়িত থাকা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে নরিয়েগা দোষী সাব্যস্ত হন। ১৯৯২ সালে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
চতুর ও প্রভাবশালী এই জেনারেলকে বাকি জীবন কারাগারেই কাটাতে হয়। তিনি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের কারাগারে বন্দী ছিলেন। ২০১১ সালে হুইলচেয়ারে করে নিজ দেশে ফেরেন। তাঁকে পানামায় পাঠিয়ে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।
মস্তিষ্কে টিউমারের অস্ত্রোপচার–সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগে ২০১৭ সালে জেনারেল নরিয়েগা মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
কারাগারে থাকা অবস্থায় নরিয়েগা বলেছিলেন, ‘আমার নেতৃত্বে পানামা যা করেছে, তা সবার জানা। পানামা খোলা বইয়ের মতো।’
পানামার সাবেক এই স্বৈরশাসক মৃত্যুর দুই বছর আগে সামরিক শাসন জারির জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।
অপারেশন জাস্ট কজ নিয়ে যত সমালোচনা
লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ অপারেশন জাস্ট কজের তীব্র সমালোচনা করে একে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রহণযোগ্য সামরিক হস্তক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দেয়। পানামার নাগরিকদের ওপর জোর করে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও অনেকে সমালোচনা করেন।
কিউবা, নিকারাগুয়া ও ভেনেজুয়েলা প্রকাশ্যে বলেছিল, পানামায় মার্কিন অভিযান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত এবং এটি ভবিষ্যতে শক্তিধর দেশগুলোর একতরফা সামরিক আগ্রাসনের বিপজ্জনক নজির তৈরি করেছে।
ইউরোপের কয়েকটি দেশের সরকারও কূটনৈতিক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছিল, এ ধরনের পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও বহুপক্ষীয় কূটনীতির সঙ্গে নীতিগতভাবে সাংঘর্ষিক। এটি বিশ্বব্যবস্থাকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
শক্তিধর দেশগুলোর এভাবে একতরফা সামরিক অভিযান বিশ্বব্যবস্থাকে কতটা অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, বর্তমান সময় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, মার্কিন জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের দপ্তরের ওয়েবসাইট