খালিস্তানপন্থীদের দমনে ভারতের ‘পুরোনো কৌশল’, আতঙ্কে কানাডার শিখরা

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশে হরদীপ সিংয়ের স্মরণে টাঙানো হয়েছে ব্যানারফাইল ছবি: রয়টার্স

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সারে শহর। সেখানে গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারা মন্দিরে চলছিল গটকা প্রতিযোগিতা। এটা একধরনের মার্শাল আর্ট। তুমুল আক্রোশে তলোয়ার ও লাঠি হাতে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন প্রতিযোগীরা। চারপাশে উৎসাহী মানুষের ভিড়।

সারে শহরে শিখ সম্প্রদায়ের বহু মানুষের বসবাস। গটকা প্রতিযোগিতার দিন মন্দিরে উপস্থিত ছিলেন গুরকিরাত সিং। তিনি বললেন, ‘আমরা একটি বিদ্রোহী সম্প্রদায়। তরুণ বয়স থেকে আমরা সন্তানদের কাছে অস্ত্র রাখার এবং নিজেকে রক্ষা করার কৌশল শিখিয়ে দিই।’

গত জুনে সারে শহরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর। এর পর থেকে শহরের শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আত্মরক্ষার কৌশল শেখার প্রবণতা বেড়েছে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়া গুরুদুয়ারা কাউন্সিলের মুখপাত্র মনীন্দ্র সিংয়ের (৪২) ভাষায়, পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেছে।

মনীন্দ্র সিং বলেন, ‘এখন বিষয়টা আর এমন নেই যে আপনাকে আরেক দিন বাঁচার জন্য লড়াই করতে হবে। কারণ, তারা (ভারত) যেভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে, আপনি জানেনই না আদৌ আর বাঁচবেন কি না। তাই হরদীপ হত্যাকাণ্ড অবাক করে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না।’

ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখদের জন্য খালিস্তান নামের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে সরব ছিলেন হরদীপ সিং। চার দশক ধরেই এ নিয়ে আন্দোলন করছেন শিখ সম্প্রদায়ের অনেকে। এর জেরে হরদীপসহ বিদেশে অবস্থান করা অনেককে সন্ত্রাসী তকমা দিয়েছে ভারত।

১৯৯৭ সালে পাঞ্জাব থেকে কানাডায় পাড়ি জমান হরদীপ সিং। তিনি গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই মনে করেন, তাঁকে হত্যার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। এরই মধ্যে গত সেপ্টেম্বর হত্যাকাণ্ডে নয়াদিল্লির সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার দাবি করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখ তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে ট্যাংক নিয়ে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের লক্ষ্য ছিল মন্দিরে অবস্থান নেওয়া সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

ট্রুডোর ওই দাবির পর ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। দুই দেশই পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের পদক্ষেপ নেয়। থমকে যায় দুই দেশের বাণিজ্যিক আলাপ-আলোচনা। এমনকি সাময়িক সময়ের জন্য কানাডার নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখে ভারত।

এরই মধ্যে গত নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তোলে, নিউইয়র্ক শহরে অবস্থান করা শিখ নেতা গুরপাতওয়ান্ত সিং পান্নুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীসংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি। এর পর থেকে সন্দেহ আরও বাড়ে—বিদেশে থাকা শিখ নেতাদের হত্যায় ঘাতক বাহিনী নিয়োগ দিয়েছে নয়াদিল্লি। তবে বরাবরই তা অস্বীকার করেছে ভারত।

এদিকে হরদীপ সিং হত্যার ছয় মাস পর সম্প্রতি সারে শহরের অনেক শিখ নেতা জানিয়েছেন, তাঁদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয়েছে। অনেককে এ নিয়ে সতর্ক করেছেন কানাডার সরকারি কর্মকর্তারা। তবু শিখ সম্প্রদায়ের অনেকেই বলছেন, যা-ই হোক না কেন, তাঁদের মুখ বন্ধ করা যাবে না।

আরও পড়ুন
খালিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে শিখদের বিক্ষোভ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘সেই আগের কৌশল’
কানাডায় ৭ লাখ ৭০ হাজার শিখ বসবাস করেন। ভারতের বাইরে অন্য কোনো দেশে সম্প্রদায়টির এত সদস্য থাকেন না। এই শিখদের অনেকের পরিবারই গত শতকের আশির দশকে ভারত থেকে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। সে সময় পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থকদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালাচ্ছিল ভারত সরকার। এমনকি শিখ আন্দোলনকারীদের অনেককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগও উঠেছিল।

১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখ তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে ট্যাংক নিয়ে অভিযান চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের লক্ষ্য ছিল, মন্দিরে অবস্থান নেওয়া সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ওই অভিযানে অনেক মানুষ নিহত হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন তীর্থযাত্রীরাও। এর চার মাস বাদে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেন তাঁর দুই দেহরক্ষী। এরপর রাজধানী নয়াদিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শিখদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। নিহত হন হাজার হাজার শিখ।

আজ অনেকে মনে করছেন, আশির দশকের মতোই শিখদের ওপর আবার হামলা চালাচ্ছে ভারত সরকার। সেবার হয়েছিল ভারতে। আর এবার কানাডায়। মনীন্দ্র সিং বলেন, ‘আমাদের মুখ বন্ধ রাখতে তারা (ভারত সরকার) মরিয়া হয়ে উঠেছে। এর জন্য তারা আমাদের হত্যাও করতে পারে। এই একই কৌশল পাঞ্জাবে কাজে লাগানো হয়েছিল।’

মনীন্দ্র মনে করেন, শিখদের খালিস্তান আন্দোলন সবচেয়ে গতি পেয়েছিল আশি ও নব্বইয়ের দশকে। এরপর তা অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। তিনি বলেন, ‘গত দশকে আমাদের শক্তি আবার বেড়েছে। আমরা একসময় আন্দোলনে সোচ্চার ছিলাম। এখন বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে অনেক ভিন্ন উপায়ে সোচ্চার হওয়া যায়। আমরা এখন দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি। আমাদের নিয়ে ভারত সরকার এখন কঠিন সময় পার করছে।’

আরও পড়ুন

‘তারা আমাদের হত্যা করতে পারে’
হরদীপ সিংকে যখন হত্যা করা হয়েছিল, প্রায় একই সময়ে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে হঠাৎ মারা যান শিখ অধিকারকর্মী অবতার সিং খান্ডা। তাঁর মৃত্যু নিয়ে স্বজনদের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। কয়েক মাস আগে অবতার সিং জানিয়েছিলেন, তাঁকে মুঠোফোনে হেনস্তা করেছিল ভারতীয় পুলিশ। এমনকি পাঞ্জাবে তাঁর পরিবারকে হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।

সারে শহরের গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার সদস্যদের ধারণা, অবতার সিংয়ের মৃত্যুর পেছনে ভারত সরকারের হাত ছিল। ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন অব কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সভাপতি গুরপ্রিত কাউর রাই বলেন, ‘যদিও যুক্তরাজ্য সরকার বলেনি যে ওই মৃত্যুর পেছনে ভারতের হাত ছিল। তবে আমরা জানি, এর সঙ্গে ভারত জড়িত।’

কানাডার শিখদের বর্তমান শঙ্কা দেখে জাসবীর সিং বুঝতে পারেন পাঞ্জাবে একসময় তাঁর পূর্বসূরিরা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন।

সারে শহরে বসবাসকারী অন্তত তিনজন শিখ জানিয়েছেন, তাঁদের জীবন হুমকির মুখে আছে বলে সতর্ক করেছে কানাডা পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। এমনই এক সতর্কবার্তা পেয়েছেন গুরু নানক শিখ গুরুদুয়ারার সদস্য গুরমিত সিং তুর। তিনি বলেন, ‘আমি কানাডা পুলিশকে বলেছি, তারা যদি হুমকিদাতাদের ধরতে না পারে, তাহলে আমরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারি।’

এদিকে হত্যার হুমকি বাদেও ভারত-সংশ্লিষ্ট আরেকটি হুমকির মুখে পড়ছে কানাডার শিখ সম্প্রদায়। সারে ও নিকটবর্তী অ্যাবোটসফোর্ড শহরে শিখ ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে বিভিন্ন অপরাধী গোষ্ঠী। তাঁদের কাছে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। কথিত আছে, ভারতীয় ‘গ্যাংস্টার’ লরেন্স বিষ্ণুর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই গোষ্ঠীগুলোর। এর আগে কানাডায় খালিস্তানপন্থীদের হত্যায় হাত থাকার দাবি করেছিল বিষ্ণু পরিচালিত অপরাধী চক্র।

আরও পড়ুন
অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির
ছবি: রয়টার্স

এসব হুমকি-ধমকি ছাড়াও কানাডায় অবস্থান করা শিখদের নিয়ে অনেকে ঈর্ষা করেন বলে ধারণা খালিস্তানপন্থী জাসবীর সিংয়ের। তিনি বলেন, ‘আপনি নিজেই এটি বুঝতে পারবেন। আমরা অনেক সফলতা পেয়েছি। কানাডার পার্লামেন্টে ১৮ জন শিখ সদস্য রয়েছেন। শিখদের অনেক ব্যবসা রয়েছে। অপরাধী চক্রগুলো মনে করে, কানাডার শিখ সম্প্রদায় ভারতবিরোধী। আমাদের যা রয়েছে, তার যোগ্য নই।’

কানাডার শিখদের বর্তমান শঙ্কা দেখে জাসবীর সিং বুঝতে পারেন, পাঞ্জাবে একসময় তাঁর পূর্বসূরিরা কেমন পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন। স্বর্ণমন্দিরে অভিযানের দুই বছর পর ১৯৮৬ সালে তাঁর জন্ম। জাসবীরের মনে পড়ে আশির দশকের সংঘাত নিয়ে নির্মিত একটি চলচ্চিত্রের কথা। খুব ছেলেবেলায় যখন চলচ্চিত্রটি দেখছিলেন, তখন পাশে বসে তাঁর মা কান্নাকাটি শুরু করেন। ছেলেবেলার সেই এক টুকরো স্মৃতি জাসবীরকে মনে করিয়ে দেয়, সে সময় কতটা ভয়ে দিন কাটাতেন পাঞ্জাবের বাসিন্দারা।

জাসবীর সিং বলেন, ‘সে সময়ের ঘটনাগুলো শোনা এক জিনিস আর ভারত সরকার ও পাঞ্জাবের স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয়তাবাদীদের ঘৃণার মুখে পড়া আরেক জিনিস। সেই ঘৃণার শিকার এখন আমরা হচ্ছি। আমাদের প্রজন্ম এক নজিরবিহীন সময় পার করছে।’