বড়দিনে যত ভিন্ন রেওয়াজ

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে বড়দিন উপলক্ষে সাজানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রিছবি: রয়টার্স

তুষারশুভ্র কেশে, অরুণরাঙা বেশে এলেন সান্তা। সঙ্গে এল উৎসব—চিরচেনা ‘জিঙ্গেল বেলস’ গানের সুর আর ক্রিসমাস ট্রি–জুড়ে লাল-নীল দীপাবলি। আজ বড়দিন—যিশুর জন্ম উৎসব। শত শত বছর ধরে খ্রিষ্টানদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব উদ্‌যাপন করা হয় বিশ্বজুড়ে—জমকালো আয়োজনে। তবে দেশ, সংস্কৃতি আর প্রথাভেদে আয়োজনে থাকে কিছু ভিন্নতা, আলাদা কিছু রেওয়াজ।

বাহারি কাগজে মোড়ানো উপহার দেওয়া-নেওয়া, টার্কির রোস্টে ভূরিভোজ আর সাজসজ্জায় আমোদ-ফুর্তি—এর বাইরে বড়দিনের আলাদা কী রেওয়াজ থাকতে পারে? আসলে বইপত্র ঘাঁটলে কিংবা হাতের মুঠোফোনে ইন্টারনেটের জগতে এদিক-সেদিক একটু ঢুঁ মারলেই বড়দিনের ভিন্ন ভিন্ন সব আয়োজন আর রেওয়াজ চোখে পড়বে। এর কিছু আবার রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো।

বড়দিন উপলক্ষে বাথটাবে ছেড়ে রাখা হয় জলজ্যান্ত মাছ—এটা কি অবাক করার মতো নয়? ইউরোপের দেশ চেক প্রজাতন্ত্রে এমনই বিচিত্র এক রেওয়াজ রয়েছে। সেখানে বড়দিনের ভোজে মূল আকর্ষণ কিন্তু টার্কি নয়, বরং মাছের পদ। কেউ যদি একান্তই মাছ খেতে পছন্দ না করেন, তাহলে একটি জ্যান্ত মাছ কিনে রেখে দেন বাথটাবে। উৎসব শেষে সেটি আবার ছেড়ে দেন কোনো জলাশয়ে।

চেক প্রজাতন্ত্রে অনেকে মাছের দু–একটা আঁশ মানিব্যাগে ভরে রাখেন। অনেকে একে কুসংস্কার মানলেও দেশটির বাসিন্দারা এই রেওয়াজে খোঁজেন সৌভাগ্য—যেন পুরো বছরই পকেট ভরে থাকে অর্থকড়িতে। বড়দিনে সেখানকার মেয়েরা জুতা ছোড়ার খেলায় মাতেন। যদি সেই জুতা বাড়ির দরজা বরাবর যায়, তাহলে ধরে নেওয়া হয় এক বছরের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন তিনি।

গুয়াতেমালায় বড়দিন উদ্‌যাপনে পোড়ানো হয় 'শয়তানের' কুশপুত্তলিকা
ছবি: এএফপি

বড়দিনে বিয়ে নিয়ে ভিন্ন এক লৌকিকতা রয়েছে বেলারুশেও। এদিন পানিতে মোম মেশান মেয়েরা—যদি কোনোভাবে দেখা যায় হবু স্বামীর চেহারা। আরেকটি মজার রীতি হলো, খাবার টেবিলের পা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা—যেন বাড়িতে শনির প্রভাব না পড়ে। বেলারুশে বড়দিনে অতিথি এলে আগে ঢুকতে দেওয়া হয় পুরুষদের। এতে নাকি পরের বছরটা ভালো কাটে বাড়িওয়ালার।

বড়দিনের প্রতীক কী? অনেকেই বলবেন ক্রিসমাস ট্রি। ১৮৩৩ সালের আগে কিন্তু গ্রিসে ক্রিসমাস ট্রির চলই ছিল না। আগের মতো দেশটিতে এখনো বড়দিনের প্রতীক নৌকা। একে বলা হয় ‘কারাভাকি’। গ্রিক লোককথায় ‘কাল্লিকান্তজারোই’ নামের একধরনের দুষ্ট প্রকৃতির চরিত্রও রয়েছে। এগুলো নাকি বড়দিনের সময় পাতাল থেকে বের হয়ে মানুষের জন্য নানা বিপত্তি ডেকে আনে।

এবার যাই মধ্য আমেরিকার দেশ গুয়াতেমালায়। দেশটিতে বড়দিনের মৌসুম শুরু হয় ‘লা কেমা দেল দিয়াবলো’ বা ‘শয়তান পোড়ানোর’ মধ্য দিয়ে। ৭ ডিসেম্বর ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় পোড়ানো হয় ‘শয়তানের’ কুশপুত্তলিকা। আত্মার শুদ্ধির জন্য এই আগুনে গুয়াতেমালার অনেকে অদরকারি নানা জিনিসও পোড়ান। যদিও উৎসবের এই রেওয়াজে পরিবেশদূষণ হয় বলে সমালোচনা রয়েছে।

আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় বড়দিনের তারিখটাই আলাদা—ডিসেম্বরে নয়, বরং ৭ জানুয়ারি। উৎসবের নামও ভিন্ন, ‘গান্না’। আসলে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের অনেকে বড়দিন জানুয়ারিতেই পালন করে থাকেন। ইথিওপিয়ার খ্রিষ্টানরা বড়দিনের আগে ৪৩ দিনের উপবাস করেন। এ সময় মাংস, চর্বিজাতীয় খাবার, ডিম ও দুধ খাওয়া মানা। উপবাস ভাঙেন ৭ জানুয়ারির ঠিক আগে।

সিরিয়ায় বড়দিনের মূল আকর্ষণ মরুর জাহাজ উট। শিশুদের মধ্যে উপহার বিলির ক্ষেত্রেও সান্তার ভূমিকায় থাকে এই উটগুলো। এই ভিন্নতা কেন? এই প্রথা আসলে এসেছে প্রাচীন এক কিংবদন্তি থেকে। তাতে বলা হয়েছে, উটে চড়েই বেথলেহেমে শিশু যিশুকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনজন জ্ঞানী মানুষ। যিশু তখন উটকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, এই প্রাণীগুলো যেন চিরকাল বেঁচে থাকে।

আসা যাক ইন্দোনেশিয়ায়। মুসলিমপ্রধান এই দেশেও বড়দিনের উৎসবে কিছু ভিন্ন রেওয়াজ দেখা যায়। যেমন উত্তর সুমাত্রার বাসিন্দাদের মধ্যে ‘মারবিন্দা’ নামের একটি প্রথা রয়েছে। এটি পালন করা হয় পশু উৎসর্গের মধ্য দিয়ে। আর রাজধানী জাকার্তার কিছু বাসিন্দা বড়দিনে পাউডার দিয়ে অন্যদের মুখ পরিষ্কার করে দেন। এই প্রথার নাম ‘রাবো রাবো’।

অস্ট্রেলিয়ায় উৎসবের এই সময়টা পুরোদস্তুর গরমকাল। বড়দিনে অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দাদের অনেকে পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সঙ্গে থাকে ব্যাট, বল আর স্ট্যাম্প। খেলা হয় ক্রিকেট। পাঁচ বছরের শিশু কি বৃদ্ধ—কোনো বাছবিচার নেই, এক দিনের জন্য পুরো পরিবার হাত ঝালিয়ে নেয় জাতীয় খেলায়।

তথ্যসূত্র: টাইম সাময়িকী ও বিবিসি