মিথ্যা গর্ভধারণের গল্প বানিয়ে নবজাতককে আনা হলো যুক্তরাজ্যে, এরপর...

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে গত গ্রীষ্মে নাইজেরিয়া থেকে আসা এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর সঙ্গে একটি নবজাতক কন্যাশিশু ছিল।

ওই নারী তাঁর স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারে বসবাস করতেন। আফ্রিকা যাওয়ার আগে তিনি তাঁর পারিবারিক চিকিৎসককে (জিপি) জানিয়েছিলেন, তিনি গর্ভবতী। কিন্তু সেই দাবি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা।

প্রায় এক মাস পর যখন ওই নারী শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে ফেরত আসেন, তখন তাঁকে শিশু পাচারের সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত কয়েক মাসে পারিবারিক আদালতে করা এ নিয়ে দুটি মামলা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে বিবিসি। এতে সাংবাদিকেরা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ করেছেন।

এসব সাংবাদিকের মতে, যুক্তরাজ্যে অবৈধভাবে নবজাতক আনার আশঙ্কাজনক ঘটনা ঘটছে। এসব শিশুর কাউকে কাউকে নাইজেরিয়ার তথাকথিত ‘বেবি ফ্যাক্টরি’ থেকে আনা হয়ে থাকতে পারে।

‘আমার বাচ্চারা সব সময় লুকানো থাকে’

গ্রেপ্তার নারীকে বিবিসির প্রতিবেদনে সুসান ছদ্মনামে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০২৩ সালের জুন থেকে স্বামী-সন্তানসহ যুক্তরাজ্যে বসবাস করছিলেন। পেশায় কেয়ারওয়ার্কার। অসুস্থ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী বা দৈনন্দিন কাজে স্বনির্ভর নন, এমন মানুষকে সহায়তাকারী ব্যক্তিকে কেয়ারওয়ার্কার বলা হয়।

এই নারীর দাবি, তিনি যুক্তরাজ্য ত্যাগের আগে থেকে গর্ভবতী ছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তাঁর গর্ভধারণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে চিকিৎসকেরা তখন টিউমারজাতীয় কিছু একটি শনাক্ত করেছিলেন। তাঁরা তা ক্যানসার বলে আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসা করাতে রাজি হননি।

পশ্চিম আফ্রিকা থেকে অবৈধ পথে শিশুদের যুক্তরাজ্যে আনা এখন নতুন কিছু নয়। করোনা মহামারির পর থেকে আমি অন্তত ১২টি এমন মামলা নিয়ে কাজ করেছি। আমার ধারণা, এটা শুধুই শুরু। গ্লোবাল সাউথ তথা উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষত আফ্রিকায় শিশুর বিনিময়ে অর্থের লেনদেন বেড়েছে।
হেনরিয়েটা ককার, যুক্তরাজ্যের সমাজকর্মী

সুসান বিবিসিকে দাবি করেন, ‘আমার সন্তানেরা সব সময় লুকোনো থাকে।’ অর্থাৎ তাঁর গর্ভে থাকা শিশুরা কখনো আলট্রাসনোগ্রাফি বা স্ক্যানে ধরা পড়ে না। তাঁর আরও দাবি, তাঁর আগের সন্তানেরাও স্ক্যানে ধরা পড়েনি। কেউ কেউ নাকি গর্ভে ছিল ৩০ মাস।

সুসান বলেন, ২০২৪ সালের জুনে তিনি নাইজেরিয়া যান এবং সেখানে সন্তান জন্ম দেন। পরে নবজাতক কন্যাশিশু নিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরলে গ্যাটউইক বিমানবন্দরে সাসেক্স পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে।

বিবিসির প্রতিবেদনে সুসানের কন্যাশিশুর নাম দেওয়া হয়েছে ‘এলেনর’। ডিএনএ পরীক্ষায় দেখা যায়, শিশুটির সঙ্গে সুসান বা তাঁর স্বামীর জিনগত কোনো সম্পর্ক নেই। তখন দ্বিতীয় ডিএনএ পরীক্ষার দাবি জানান সুসান। তাতেও একই ফল আসে।

এরপর গল্প বদলে ফেলেন সুসান। এবার দাবি করেন, ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্যে আসার আগে নাইজেরিয়াতে তিনি একজন দাতার শুক্রাণু দিয়ে গর্ভধারণে আইভিএফ পদ্ধতির চিকিৎসা করিয়েছিলেন। তাই পরীক্ষায় এলেনরের সঙ্গে তাঁদের (দম্পতির) ডিএনএর মিল পাওয়া যায়নি।

আইভিএফ বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন হলো বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার একটি আধুনিক পদ্ধতি। এতে নারী ও পুরুষের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু শরীরের বাইরে (ল্যাবরেটরিতে) মিলিয়ে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই ভ্রূণ নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়, যেন সেখানে গর্ভধারণ ঘটে।

সুসান তাঁর সর্বশেষ দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে নাইজেরিয়ার একটি ক্লিনিক ও হাসপাতালে আইভিএফ চিকিৎসা এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার কাগজপত্র, ছবি (ইমেজ) ও ভিডিও জমা দেন। কিন্তু এসব ছবি বা ভিডিওতে কারও মুখ স্পষ্ট করে দেখা যায়নি।

এই নারীর দাবি, তিনি যুক্তরাজ্য ত্যাগের আগে থেকে গর্ভবতী ছিলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তাঁর গর্ভধারণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে চিকিৎসকেরা তখন টিউমারজাতীয় কিছু একটি শনাক্ত করেছিলেন। তাঁরা তা ক্যানসার বলে আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসা করাতে রাজি হননি।

শিশুর বিনিময়ে অর্থ

যুক্তরাজ্যের লিডসের পারিবারিক আদালত বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হেনরিয়েটা ককারকে দায়িত্ব দেন। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করেন এবং এ ধরনের মামলায় আদালতের জন্য বিশেষ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। তিনি যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে লন্ডনে শিশু সুরক্ষার ফ্রন্টলাইন বিভাগে কাজ করেন, পরে আফ্রিকায় চলে যান।

পশ্চিম আফ্রিকা থেকে অবৈধ পথে শিশুদের যুক্তরাজ্যে আনা এখন নতুন কিছু নয় উল্লেখ করে ককার বিবিসিকে বলেন, ‘করোনা মহামারির পর থেকে আমি অন্তত ১২টি এমন মামলা নিয়ে কাজ করেছি। আমার ধারণা, এটা শুধুই শুরু।’ তাঁর মতে, গ্লোবাল সাউথ তথা উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষত আফ্রিকায় শিশুর বিনিময়ে অর্থের লেনদেন বেড়েছে।

২০২১ সালে শিশু পাচারের অভিযোগের পর নাইজেরিয়া থেকে শিশু দত্তক গ্রহণে বিধিনিষেধ আরোপ করে যুক্তরাজ্য। এর আগে দুই দশকজুড়ে দেশটির (যুক্তরাজ্য) পারিবারিক আদালতে এমন বহু মামলার শুনানি হয়েছে।

২০১১ ও ২০১২ সালে নাইজেরিয়ার দুই দম্পতি আদালতকে বলেন, তাঁরা চিকিৎসার মাধ্যমে ‘অলৌকিকভাবে’ সন্তান পেয়েছেন। কিন্তু বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, এসব ‘চিকিৎসা’র আড়ালেই শিশু কেনাবেচা চলছিল।

২০১৩ সালে নাইজেরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর লাগোসে অবস্থিত ব্রিটিশ হাইকমিশন কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্র, যেমন জন্মসনদের জালিয়াতি ঠেকাতে নবজাতকের ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিল।

হাইকমিশন ১২টি দম্পতির ওপর তদন্ত চালিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। পরবর্তী সময়ে তিনি অভিবাসন আইনে অভিযুক্ত হন।

২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর এ নীতিতে পরিবর্তন আনে। তখন জানানো হয়েছিল, অভিবাসন–সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীদের ওপর জোর করে ডিএনএ পরীক্ষা করানো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ককার বলেন, (নাইজেরিয়ায়) এখন কিছু ক্লিনিক ‘প্যাকেজ’ দিচ্ছে। এর মধ্যে শিশুর জন্মনিবন্ধন থেকে শুরু করে তার বিদেশগমন প্রক্রিয়া—পুরোটাই অন্তর্ভুক্ত। যাতায়াত বাদে এতে খরচ পড়ছে দুই হাজার থেকে আট হাজার পাউন্ড।

ককার মনে করেন, এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার। তবে এসব অপরাধ ঠেকানো কঠিন। কারণ, যেসব দেশে এসব শিশুর জন্ম হচ্ছে, সমস্যার মূল সেখানেই রয়ে গেছে।

যুক্তরাজ্য সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, ‘যেসব ব্যক্তি ভুয়া পরিচয়ে শিশুর অভিভাবক সেজে যুক্তরাজ্যে ঢোকার চেষ্টা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে যুক্তরাজ্যে নাইজেরিয়ার হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তারা মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।