‘আমাদের যেন মুরগির পা খেয়ে বাঁচতে না হয়’

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মিসরে মুরগির পা রান্না করে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে
ফাইল ছবি: এএফপি

মিসর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। জনগণ তাদের পরিবারকে তিনবেলা খাওয়ানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে মুরগির পা রান্না করে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, মুরগির পা কুকুর ও বিড়ালের জন্য রাখা হলেও এটি খুবই প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। কর্তৃপক্ষের এমন পরামর্শে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মুখেও পড়েছে সরকার।

মিসরের গিজা মার্কেটে একজন ভিক্ষুক বলেছেন, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, মুরগির পা খেতে হবে, এমন পর্যায়ে আমাদের পৌঁছাতে দেবেন না।’

বিশ্বের অনেক দেশ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিসর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটিতে রান্নার তেল ও পনিরের মতো মৌলিক উপাদানগুলো এখন বিলাসিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিছু পণ্যের দাম গত কয়েক মাসের মধ্যে দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে।

তিন সন্তানের মা ৬০ বছর বয়সী ওয়েদাদ বলেছেন, ‘আমি মাসে একবার মাংস খাই। কখনো কখনো কিনি-ই না। আর সপ্তাহে একবার মুরগি কিনি। বর্তমানে একটি ডিমও মিসরীয় পাঁচ ডলারে বিক্রি হচ্ছে।’

মিসরে মোট জনসংখ্যা ১০ কোটি। এ বিপুলসংখ্যক জনগণকে খাওয়ানোর জন্য দেশটি দেশীয় কৃষির পরিবর্তে আমদানি করা খাদ্যের ওপর নির্ভর করে। এমনকি মুরগির খাবারের জন্য বাইরের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণেই অর্থনৈতিক এ সংকটকালে দেশটিকে লড়াই করতে হচ্ছে বেশি।

গত বছর মিসরীয় পাউন্ড মার্কিন ডলারের তুলনায় অর্ধেক মূল্য হারিয়েছে। এ কারণে গত জানুয়ারিতে সরকার আবার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। এতে শস্য আমদানির ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।

মিসরে কিছু কিছু পণ্যের দাম গত কয়েক মাসের মধ্যে দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ওয়েদাদ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার মিসরীয় ডলার পেনশন পান। এই অর্থ দিয়ে এক বছর আগেও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারতেন। তিনি নিজেকে মধ্যবিত্ত হিসেবে পরিচয় দেন। বর্তমানে অন্য মিসরীয়দের মতো সংকট মোকাবিলায় লড়াই করে যাচ্ছেন।

মুরগি কেনার জন্য কিছু অর্থ জমিয়ে বাজারে এসেছেন ওয়েদাদ। তিনি বলেন, ‘একজন বিক্রেতা মুরগির এক কেজি বুকের মাংসের দাম চাইছেন ১৬০ মিসরীয় ডলার। কেউ কেউ ১৭৫ থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত চাইছেন। মুরগির রানের কেজি ৯০ ডলার। এখন মুরগির হাড়ও বিক্রি হচ্ছে। আর মুরগির পায়ের দাম ২০ ডলার।’

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি বর্তমান এ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ২০১১ সালে অভ্যুত্থান ও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করেন। কারণ হিসেবে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা মহামারির দিকেও ইঙ্গিত করেছেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মিসর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম আমদানিকারক। আর এ দেশ দুটি ছিল এর প্রধান সরবরাহকারী। যুদ্ধের কারণে রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় গম রুটির দাম বেড়ে যায়।

রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক পর্যটক মিসরে ঘুরতে যান। করোনার সময় সেটা বন্ধ ছিল। আর এখন যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে এ খাত থেকে বিপুল অর্থ হারাচ্ছে দেশটি। মিসরের জিডিপির ৫ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে, যা এখন প্রায় বন্ধ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিসরের সরকারের ভুল পদক্ষেপের কারণে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

থিঙ্কট্যাংক দ্য তাহরির ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট পলিসির রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ টিমোথি কালদাস বলেন, প্রেসিডেন্ট সিসি যখন দায়িত্বে ছিলেন তখন সামরিক, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার ক্ষমতা এবং প্রভাব দুটোই বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় চুক্তির মাধ্যমে দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশাল অবকাঠামো প্রকল্প দেওয়া হয়েছে।

দেশটির বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা সংকুচিত হয়েছে। সরকারের সঙ্গে থাকতে না পারায় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। এ কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ ত্যাগ করে চলে গেছেন।

মিসর গত ছয় বছরে চারবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ঋণ চেয়েছে। এতে দেশের রাজস্বের প্রায় অর্ধেক এ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে। এর পরিমাণ জিডিপির ৯০ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্পদ কিনে মিসরকে সহায়তা করছে। তবে আরও বিনিয়োগের জন্য তারা বেশ কঠোর শর্ত দিচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি ব্যর্থ হলে পশ্চিম ও উপসাগরীয় উভয় প্রতিবেশীই তাদের পতনের আশঙ্কা করছে।

এর আগে দেশটির অর্থনৈতিক সংকট দাঙ্গার সৃষ্টি করেছিল, যা সাবেক তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক ও মোহাম্মদ মুরসির পতনে তরান্বিত করেছিল। আর বর্তমানে অর্থনীতির ওপর ক্রমবর্ধমান জনগণের ক্ষোভ আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, এমন লক্ষণও ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মাসে একবার মাংস খাওয়ার সামর্থ্য হারাচ্ছে মিসরের মধ্যবিত্তরা
ফাইল ছবি: এএফপি

মিসরের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে একজন গৃহবধূর একটি ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিও চিত্রে ওই নারী প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমরা আপনাকে ভোট দিতে গিয়েছিলাম, এ কালো দিনটির জন্য নারীরা কীভাবে অনুশোচনা করি, তা আপনাকে বলতে পারব না। আপনি আমাদের জীবনকে নরক বানিয়ে দিয়েছেন।’ তিনি মানিব্যাগ থেকে বের করে কিছু অর্থ গুনে জানতে চান, কীভাবে তিনি এটি দিয়ে বাচ্চাদের খাওয়াবেন।

বাজার সেরে ঘরে ফিরে ওয়েদাদ নাতি-নাতনিদের জন্য ঐতিহ্যবাহী খাবার ফাসোউলিয়া খাদরা রান্নার জন্য মরটশুঁটি ও টমেটো কাটা শুরু করেছেন। এসব কাটতে কাটতে তিনি বলেন, ‘এ বছর আমি কী করব? হয়তো মুরগিও শিগগির খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। কেবল হয়তো মসুর ডাল দিয়ে জীবন চালাতে হবে।’