কীভাবে এ জগতে এলেন, জানালেন দুই যৌনকর্মী

প্রতীকী ছবি এএফপি

প্রাণোচ্ছল ও ব্যস্ততম সমুদ্রসৈকতের দিকে একঝলক তাকালেই বুঝে ফেলা যায় এর আভিজাত্য। সাগরের তীরবর্তী রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ, হোটেল এবং টাটকা সব খাবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ স্থানের খুব কাছেই আবার বিপরীত চিত্র। সেখানে আছে এক অন্ধকার জগৎ, যেখানে নারীরা প্রতিনিয়ত মাদকের ফাঁদে পড়েন, যৌন নিপীড়নের শিকার হন। কম বয়সী, সর্বস্বান্ত ও অসহায় নারীরাই মূলত এ জগতে আটকা পড়েন।

কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধের পর এখনো সহিংসতার হুমকিতে থাকা সোমালিয়ার মোগাদিসু শহরটিতে নারীরা কীভাবে যৌন পেশার অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছেন, তা নিয়ে দুজন নারীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। ওই দুই নারীই যৌনকর্মী। তাঁদের পরিচয় গোপন রাখার স্বার্থে বিবিসির প্রতিবেদনে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ বছর বয়সী ফারদোসা তিন বছর ধরে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। মোগাদিসুর ওয়ার্ডহাইলি এলাকার বাসিন্দা তিনি। লাল পর্দায় ঘেরা অন্ধকার একটি কক্ষে বসে বিবিসির প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন এই নারী।

ফারদোসা বলেন, ১৯ বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছেড়েছিলেন। সোমালি সমাজের জন্য এটি বিরল ঘটনা। কারণ, সেখানকার অল্প বয়সী মেয়েরা বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গ ছাড়ে না।

তবে ফারদোসা বলেন, সৎমায়ের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমার মা মারা যাওয়ার পর তিনি (সৎমা) বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে ঘরে এলেন। তখন আমি ছোট ছিলাম। বছরের পর বছর ধরে তিনি আমার সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করেছেন। এরপরও আমার বাবা সব সময় তাঁর পক্ষ নিতেন।’

ঘর ছাড়ার পর নতুন নতুন মানুষদের সঙ্গে ফারদোসার বন্ধুত্ব হতে থাকে। তিনি তাঁদের সঙ্গে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন এসব ‘বন্ধু’ তাঁর সমব্যথী। ফারদোসা বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, তারা আমার কথা ভাবে। তবে এখন পেছন ফিরে তাকালে আমি বুঝতে পারি, তারা আমার সত্যিকারের বন্ধু ছিল না।’
এরপর ধীরে ধীরে তিনি মরফিন, ট্রামাডল ও পেথিডিনের মতো ব্যথানাশকগুলোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। লিডো সমুদ্রসৈকত এলাকার কাছে এক অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়েন তিনি। সেখান থেকেই যুক্ত হন যৌন পেশায়।

একসময় খদ্দের খুঁজতে কখনো হোটেলে, কখনো অচেনা মানুষের বাড়িতে কিংবা নির্জন কোনো স্থানে যেতে হতো তাঁকে। তবে এখন সাধারণত খদ্দেরদের সঙ্গে ফোনেই যোগাযোগ হয়।

ফারদোসা বলেন, ‘ফোন বাজার অপেক্ষায় থাকি। এরপর যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য মানুষটির সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। অন্য সময় খদ্দের তৈরি করে আমার মেয়েবন্ধুরা আমাকে ফোন দেয়।’

সব ধরনের মানুষের মুখোমুখি হতে হয়
ফারদোসা বলেন, ‘শুরুতে আমার নারী বন্ধুদের যে পুরুষবন্ধু ছিল, তারাই আমার খদ্দের ছিলেন। এরপর এমন সব মানুষের সঙ্গে আমার যৌন সম্পর্ক হতে থাকে, যাদের আমি চিনতাম না। এ শহরের অনেক কম বয়সী নারীর মতো আমিও অসহায় ছিলাম। নেশার আসক্তি মেটাতে আমার অর্থের প্রয়োজন ছিল।’

হোদান নামের আরেক নারী আড়াই বছর ধরে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। বয়স ২৩ বছর। ফারদোসার মতো তিনিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। এরপর মোগাদিসুর অন্ধকার জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেখানকার সবাই যৌনকর্মী। তাঁরা সবাই অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর করার মতো কোনো জায়গা তাঁদের নেই।

হোদান বলেন, ‘আমি বেশির ভাগ রাতই হোটেলে কাটাই। এখানে যে নারীরা আছেন, তাঁদের সবার একই অবস্থা। সেখানে সব ধরনের পুরুষেরাই আছেন। কিন্তু  তাঁদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁদের সঙ্গে তর্কে জড়ালে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে।’


পদে পদে বিপদ

সোমালিয়ায় যৌন পেশা অবৈধ হওয়ায় এ পেশায় জড়িত নারীদের অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে কোনো অভিযোগও করতে পারেন না।
এ ব্যাপারে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে সোমালিয়ার পুলিশ এবং দেশটির নারী ও মানবাধিকার উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মন্তব্য জানার চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।

ফারদোসার মতো যৌনকর্মীদের কেউ কেউ এখন ফোনের মাধ্যমে তাঁদের খদ্দেরদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এর মধ্য দিয়ে বিপজ্জনক জায়গাগুলো এড়ানোর চেষ্টা করেন তাঁরা।

হোদান বলেন, অনেক সময়ই মেয়েরা তাঁদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে ফিরে আসেন। অনেক সময় কম বয়সী যৌনকর্মীরা যাঁদের ভরসা করেন, তাঁরাই তাঁদের ফায়দা লুটে নেন।

প্রতীকী ছবি
ছবি: এএফপি

ফারদোসাও বললেন একই কথা। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমি পুরুষ খদ্দেরদের পছন্দের জায়গায় গিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছি। কিন্তু এক রাতে আমাকে পেটানো হয়। আমার মুখে কালশিটে দাগ পড়ে গিয়েছিল এবং রক্ত বের হচ্ছিল।’

এই যৌনকর্মী বলেছেন, দরদাম নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় তাঁর ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এর পর থেকে যত বেশি অর্থ পরিশোধের প্রস্তাবই দেওয়া হোক না কেন, তিনি কোনো পুরুষের সঙ্গেই এখন আর নির্জন জায়গায় যান না। বরং চেনাজানা হোটেলগুলো বেছে নেন। কারণ, সেখানে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে না কিংবা বিপদে পড়লেও সহযোগিতা পাওয়া যায়।

ফারদোসা বলেন, ‘অনেক যৌনকর্মী এতটা সৌভাগ্যবান নন। যৌনকর্মীরা এসব মানুষদের সঙ্গে তাঁদের বাড়ি কিংবা নির্জন জায়গায় যান এবং নিপীড়নের শিকার হন। এমনকি ধর্ষণও করা হয়। কখনো কখনো একাধিক ব্যক্তিও ধর্ষণ করে।’
তিনি আরও বলেন, মাঝেমধ্যে এসব নিপীড়নের দৃশ্য ভিডিও করে যৌনকর্মীদের মানসিকভাবে জিম্মি করে রাখা হয়।

হোদান বলেছেন, যৌনকর্মীদের মাদক দিয়ে তারপর ভিডিও করা হয়। দালালেরা তাঁদের মুনাফা ভাগাভাগি করার জন্য নিপীড়ন চালান। তাঁদের প্রস্তাবে রাজি না হলে সে ভিডিওকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।

এই যৌনকর্মী আরও বলেন, তাঁর পরিচিত অনেক কম বয়সী মেয়ের সঙ্গেই এমনটা ঘটেছে। বেশির ভাগই এসব কথা প্রকাশ করতে লজ্জা পান।

সহযোগিতা করার কেউ নেই
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বিশ্বে যৌন সহিংসতার ঘটনা অনেক বেড়েছে। সংঘাতপূর্ণ এলাকাগুলোতে এমন ঘটনা বাড়ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যথাযথ আইন না থাকায় অপরাধীরা মুক্তভাবে চলাফেরা করেন। ভুক্তভোগীরা কোনো সহযোগিতা পান না বললেই চলে।

সোমালিয়ায় যৌন পেশায় নিয়োজিত নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাঁদের সমাজচ্যুত বলে বিবেচনা করা হয়। এ কারণে তাঁরা কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারেন না।
সোমালিয়ায় নারীদের বেশ কয়েকটি সংগঠন আছে। তবে বিবিসির পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি স্পর্শকাতর উল্লেখ করে তারা কথা বলতে রাজি হয়নি।

হোদান ও ফারদোসা দুজনই বলেছেন, তাঁদের মতো নারীদের সহযোগিতা করার মতো প্রতিষ্ঠান থাকলে অনেক নারীই এমন বিপজ্জনক পেশায় আসতেন না। অসহায় হয়েই তাঁরা এমন সহিংস ও শোষিত জীবনযাত্রার ফাঁদে পড়ছেন।

ফারদোসা বলেন, কম বয়সী মেয়েদের অনেকে মাদকাসক্তি কাটাতে পারছে না। এতে তারা বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে। তাদের অনেকের রাতে ঘুমানোর জায়গাও নেই। তারা লিডো সৈকতের আশপাশে কিংবা শহরের অন্যান্য এলাকার রাস্তায় ঘুমায়। অন্যরা পুরুষদের সঙ্গে কোথাও ঘুমাতে চলে যান। তখন তাঁরা আরও বেশি করে যৌন নিপীড়নের শিকার হন।

ফারদোসা যখন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর পেছনেই এক নারীকে বসে থাকতে দেখা গেল। তাঁর কোলে এক শিশু। এ নারীর নাম আমিনা। তিনিও একসময় যৌনকর্মী ছিলেন। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর তিনি এ পেশা ছেড়ে দেন।

ফারদোসা বলেন, ‘আমিনা সব সময় আমাকে এ জীবন ছেড়ে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। তবে তা তো অত সহজ নয়। প্রিয়জনের মুখোমুখি হওয়াটা কঠিন। তিন বছর ধরে আমি পরিবারের মানুষদের দেখি না।’