পথেই সন্তান প্রসব রেডিও উপস্থাপকের, কোলে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু

নবজাতক সন্তানকে কোলে নিয়ে আরাফা আদোম
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

সুদানে চলমান যুদ্ধে তিন ছেলেকে হারানোর পর আর নিজ এলাকায় থাকার সাহস পাচ্ছিলেন না অন্তঃসত্ত্বা আরাফা আদোম। সন্তানদের হারানোর পাশাপাশি অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার শঙ্কা পেয়ে বসে তাঁকে। কারণ, তাঁর সন্তান প্রসবের সময় আসন্ন। তাই ঝুঁকি নিয়েই সুদানের দারফুর অঞ্চল থেকে সীমান্তবর্তী দেশ চাদের পথে পা বাড়ান পেশায় রেডিও উপস্থাপক আরাফা।

কিন্তু বড্ড দেরি করে ফেলেছেন আরাফা। দেশত্যাগের সময় চলার পথেই তাঁর প্রসব বেদনা ওঠে। সময়টা এমনই ছিল যে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। সড়কে সন্তানের জন্ম দেন তিনি।

আরাফা আদোম বলেন, ‘আমাকে সহায়তা করার মতো কোনো দাই বা অন্য কেউ ছিলেন না। প্রত্যেকে তখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যেকে নিজের জীবন বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে।’

চাদের শহরতলিতে থাকা শরণার্থীশিবিরে আরাফার সঙ্গে কথা হয় বিবিসির এই প্রতিবেদকের। আরাফা বলেন, ‘গর্ভ থেকে নবজাতক বের হওয়ার পর আমিই তাকে পেঁচিয়ে কোলে নিই। আমি আর কিছু নিয়ে ভাবিনি। আমি আদ্রের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।’

সুদানের প্রফেশনাল ফার্মাসিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। শহরে ১১ হাজার মরদেহ গণকবর দেওয়া হয়েছে। আবার কয়েকজন শরণার্থী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা অনেক লাশ নদীতে ফেলে দিতে দেখেছেন।

৩৮ বছর বয়সী এই নারী বলেন, প্রখর রোদের মধ্য দিয়ে তিনি নিজ শহর এল জেনেইনা থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে গেছেন। সঙ্গে ছিল তাঁর চার মেয়ে। আর তাঁর স্বামী নিজে যেন নিরাপদে শিবিরে পৌঁছাতে পারেন, সে জন্য দীর্ঘ ও দুর্গম একটি পথকে বেছে নেন।

আরাফা বলেন, নবজাতক ছেলের নাম মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর নামে রেখেছেন। পাশের দেশে ঠাঁই নিলেও নিজ শহরে ফেলে গেছেন ৩, ৭ ও ৯ বছর বয়সী তিন ছেলের মরদেহ। তাদের মরদেহ তাঁরা দাফন করতে পারেননি। তাঁর দাবি, আধা সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) ও তাদের মিত্র আরব মিলিশিয়ারা তাঁর তিন সন্তানকে হত্যা করেছে।

সুদানে লড়াইয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দারফুর। আরএসএফ ও আরব মিলিশিয়ারা এই অঞ্চলে মাসালিত সম্প্রদায়সহ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের ‘নিধন’ করে আরব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আরাফ মাসালিত সম্প্রদায়ের মানুষ।

এল জেনেইনা হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে দারফুরে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শক্তির প্রতীক। মাসালিত রাজতন্ত্রের রাজধানী ছিল দারফুর। এই অঞ্চলের মানুষ বাইরের শক্তির কাছে অবাধ্য হিসেবে পরিচিত ছিল।

চাদের আদ্রেতে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেওয়া সুদানের মানুষজন। বলা হচ্ছে মাসালিত সম্প্রদায়ের ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ চাদে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে
ছবি: এএফপি

প্রভাবশালী মাসালিত নেতা শেখ মোহাম্মদ ইয়াগোভ বলেন, ‘আমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা খুব ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছিল।’ ইয়াগোভ নিজেও এখন আদ্রেতে শরণার্থীশিবিরে আছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় আমরা এক দিনে তিন ঘণ্টায় ৮২ জনকে হারিয়েছি।’

আরএসএফ যুদ্ধে জড়ানোর কথা অস্বীকার করেছে। তবে ইয়াগোভ বলেন, দারফুর আরব গোষ্ঠী ও মাসালিতদের মধ্যে একটি পুরোনো সংঘর্ষের পুনরুত্থানের সাক্ষী হলো।

আরাফা আদোম বলেন, আল জেনেইনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। আরএসএফ ও আরব মিলিশিয়ারা সেখানে গুলি চালায় ও আগুন দেয়। সেই গোলার আঘাতে তাঁর তিন ছেলের মৃত্যু হয়।

নিজের তিন সন্তান ছাড়াও পরিবারের অনেককে হারিয়েছেন আরাফা। তাঁদের মধ্যে তাঁর শ্বশুরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর দুটি পা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, একটি কান কেটে দেয় এবং এরপর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপরই আরাফা ও তাঁর স্বামী চার মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যান।

ঘরের শেষ সম্বলটুকো নিয়ে জেনেইনা থেকে পালাচ্ছেন লোকজন। গন্তব্য চাদের আদ্রে। ২৩ জুলাই
ছবি: রয়টার্স

তবে আরাফার স্বামী জানতে পারেন, তাঁরা যে পথে যাবেন, সে পথ অবরোধ করে রেখেছে আরএসএফ বাহিনী। তাই তিনি অন্য পথ বেছে নেন। কারণ, আরএসএফ বাহিনী মাসালিত সম্প্রদায়ের পুরুষ ও ছেলেদের ধরে ধরে হত্যা করে। অনেক সময় তাঁদের গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

আরাফার স্বামী চাদের শরণার্থীশিবিরে প্রথমবারের মতো সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নেওয়ার সুযোগ পান। তিন ছেলেকে হারানো এই মা–বাবা আরেক ছেলে পাওয়াকে আল্লাহর নেয়ামত মনে করছেন।

মাসালিত নেতা শেখ মোহাম্মদ ইয়াগোভের স্ত্রী রোকেয়া আদুম আবদেলকরিম এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনিও অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দিয়ে আদ্রে পৌঁছাতেই ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ওই সময়টুকু তাঁর পেটে কোনো দানা পড়েনি। এই ধকল নিতে পারেনি অনাগত সন্তান। আদ্রে পৌঁছানোর এক দিন পর তাঁর রক্তক্ষরণ শুরু হয়। মাথাব্যথাও হচ্ছিল। ভোরবেলা ভ্রূণটি বেরিয়ে আসে।
আদ্রেতে একটি দাতব্য সংস্থা অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করেছে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য সেখানে যেতে পারেননি রোকেয়া।

মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সুদান সংকট নিয়ে দেশটির প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গে আঞ্চলিক বৈঠক করেন। ১৩ জুলাই। মিশরের কায়রোতে ইত্তিহাদিয়া প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ, কায়রো, মিসর, ১৩ জুলাই
ছবি: রয়টার্স

অস্থায়ী হাসপাতালটি রোগীতে ভর্তি। বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তাঁদের মধ্যে অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়েছেন।

নাইমা আলী নামের এক রোগী বলেন, তিনি তাঁর ৯ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে পালানোর সময় আরএসএফ বাহিনীর গুলিতে আহত হন। ছেলে তাঁর পিঠে বাঁধা ছিল। গুলিটি ছেলের পায়ে লেগে আমার শরীরে লাগে। সৌভাগ্যবশত কিডনিতে লাগেনি।

হেঁটে পালিয়ে ছিলেন নাইমা। তিনি বলেন, ‘শরণার্থীশিবিরে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি থামিনি। আমাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। সাহায্য করার কেউ ছিলেন না।’

ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব থেকে সুদানে গত ১৫ এপ্রিল এই যুদ্ধের শুরু হয়। একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে আধা সামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। একসময় মিত্র ছিল দুই বাহিনী। ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তারা। কিন্তু আরএসএফকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে।

আরাফা আদোম বলেন, আল জেনেইনার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আরএসএফ ও আরব মিলিশিয়ারা সেখানে গুলি চালায় ও আগুন দেয়। সেই গোলার আঘাতে তিন ছেলেকে হারাই।
আরাফা আদোম

আরএসএফ ও সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্ব দারফুরে আবারও সংঘাতকে জাগিয়ে তুলেছে। মাসালিত সম্প্রদায়ের ১ লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ চাদে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই অঞ্চলে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে আল জেনেইনাতে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

সুদানের প্রফেশনাল ফার্মাসিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। শহরে ১১ হাজার মরদেহ গণকবর দেওয়া হয়েছে। আবার কয়েকজন শরণার্থী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা অনেক লাশ নদীতে ফেলে দিতে দেখেছেন।

দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় বোমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ওপরে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। খার্তুম নর্থ, সুদান ১ মে ছবি
ছবি: রয়টার্স

দারফুরের অনেকের ভাষ্য, আল জেনেইনাসহ অসংখ্য শহর ও গ্রাম খালি হয়ে গেছে। হাসপাতাল, পানি স্টেশনসহ ভবন ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। মাসালিত নেতা শেখ মোহাম্মদ ইয়াগোভ বলেন, ২০০৩ সালে যা হয়েছিল, এখন পরিস্থিতি তার চেয়ে খারাপ। চিকিৎসক, আইনজীবীসহ বিশেষ ব্যক্তিদের হত্যা করা হচ্ছে।

আরাফা সৌভাগ্যবতী। কারণ, যুদ্ধের শুরুর দিকে যখন তাঁদের রেডিও স্টেশন রেডিও আল জেনেইনাতে হামলা চালানো হয়, তখন তিনি বেঁচে যান। তিনি বলেন, তারা সব যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে দিয়েছে। যা পেয়েছে, সব লুট করে নিয়ে গেছে।

আরাফা এখন লাঠি ঠেক দিয়ে তার ওপর কাপড় দিয়ে তৈরি করা ঘরে থাকেন। জানেন না, আদৌ নিজ বাড়িতে ফেরা হবে কি না। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে শরণার্থী হিসেবে এসেছি। পথে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আমাদের চলতে হয়েছিল।’