বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে কেন স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ইসরায়েল
রাষ্ট্র হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ইসরায়েল। বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েল এ স্বীকৃতি দিচ্ছে। এটিকে হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গতকাল শুক্রবার ঘোষণা দেন, পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ইসরায়েল ও সোমালিল্যান্ড একটি যৌথ ঘোষণাপত্র সই করেছে।
‘আব্রাহাম চুক্তি’র চেতনার আলোকে এ ঘোষণাপত্র সই করা হয়েছে বলেও জানান নেতানিয়াহু। আরব দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এ আব্রাহাম চুক্তি করেছিল ইসরায়েল।
ইসরায়েলের এমন ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটি বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে সোমালিয়া সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটি সোমালিয়ার ‘সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ’ এবং একটি ‘বেআইনি’ পদক্ষেপ। সোমালিয়া সরকার বলেছে, সোমালিল্যান্ড তাদের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
১৯৯১ সালে সোমালিয়ার কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল সোমালিল্যান্ড। তবে এ ভূখণ্ড এত বছরের জাতিসংঘের কোনো সদস্যদেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়নি। একসময়ের ব্রিটিশশাসিত উত্তর সোমালিয়ার উত্তর–পশ্চিম কোণে এ ভূখণ্ডের অবস্থান।
১৯৯১ সালে সোমালিয়ার কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল সোমালিল্যান্ড। তবে এ ভূখণ্ড এত বছরের জাতিসংঘের কোনো সদস্যদেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায়নি। একসময়ের ব্রিটিশশাসিত উত্তর সোমালিয়ার উত্তর–পশ্চিম কোণে এ ভূখণ্ডের অবস্থান।
সোমালিল্যান্ডের স্বাধীনতার ঘোষণাকে কখনোই মেনে নেয়নি সোমালিয়া।
তীব্র সমালোচনা, প্রত্যাখ্যান
প্রথম দেশ হিসেবে ইসরায়েল সোমালিল্যান্ডকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সোমালিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদিসালাম আবদি আলী মিসর, তুরস্ক ও জিবুতির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। এ সময় তিনটি দেশই সোমালিয়ার অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে সোমালিল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত আব্রাহাম চুক্তিতে সই করা দেশ।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সার্বভৌম দেশের মধ্যে একটি অঞ্চলের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। এর মধ্য দিয়ে একটি ‘বিপজ্জনক নজির’ গড়া হচ্ছে বলেও তিনটি দেশ একমত হয়েছে।
রাষ্ট্রগুলোর ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক স্তম্ভ। কোনোভাবেই এটা লঙ্ঘন করা উচিত নয়—বলেছে মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ভিডিও কলে সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আবদিরাহমান মোহামেদ আবদুল্লাহিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। এ সময় দেশটির প্রেসিডেন্টের ‘নেতৃত্ব এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতি প্রতিশ্রুতির’ প্রশংসা করে তাঁকে ইসরায়েল সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
ইসরায়েলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার বলেন, দুই সরকারের মধ্যে বছরখানেকের সংলাপের পর এ যৌথ ঘোষণাপত্র সই হয়েছে। দুই দেশের সরকার আর রাষ্ট্রপ্রধানের যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে। এর আওতায় উভয় দেশে পরস্পরের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ ও দূতাবাস খোলা হবে।
যৌথ ঘোষণাপত্র সইয়ের বিষয়টিকে ‘ঐতিহাসিক একটি মুহূর্ত’ বলে উল্লেখ করেছেন সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট। তিনি জানান, আব্রাহাম চুক্তিতে যোগ দিতে তাঁর দেশ প্রস্তুত রয়েছে।
গতকাল এক বিবৃতিতে ‘সোমালিল্যান্ডের যেকোনো স্বীকৃতি’ প্রত্যাখ্যান করেছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। সোমালিয়া আফ্রিকান ইউনিয়নের সদস্য। সোমালিল্যান্ডকে সদস্যদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করে আফ্রিকান ইউনিয়ন।
বিবৃতিতে আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান মাহামুদ আলী ইউসুফ বলেন, সোমালিয়ার ঐক্য, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা ক্ষুণ্ন করার যেকোনো চেষ্টা মহাদেশজুড়ে শান্তি, স্থিতিশীলতার জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাবসহ একটি বিপজ্জনক নজির স্থাপন করতে পারে।
পরিবর্তনের সূচনা
স্বাধীনতা ঘোষণা করার তিন দশকের বেশি সময় পর এসে প্রথম কোনো দেশের স্বীকৃতি পেতে যাওয়ার ঘটনাটি বহু বছরের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা পেরিয়ে সোমালিল্যান্ডের ভাগ্য ফেরাতে নাটকীয় পরিবর্তন আনবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
কর্তৃত্ববাদী শাসক সিয়াদ বারের কয়েক দশকের শাসনামলে চলা নৃশংস গৃহযুদ্ধের সময় অঞ্চলটি সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই সময় সরকারি বাহিনী সোমালিয়ার উত্তরাংশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল।
সিয়াদ বারের কর্তৃত্ববাদী সরকারের অধীন কয়েক দশক ধরে চলা এক নৃশংস গৃহযুদ্ধের সময় এই অঞ্চল সোমালিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। সিয়াদের বাহিনী উত্তরাঞ্চলকে ধ্বংস করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সোমালিয়ার বড় অংশ যখন বিশৃঙ্খলায় ডুবে যায়, তখন ১৯৯০–এর দশকের শেষের দিকে সোমালিল্যান্ডে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।
ধীরে ধীরে সোমালিয়ার কাছ থেকে আলাদা একটি রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে তুলেছে সোমালিল্যান্ড। তাদের নিজস্ব সংসদ, মুদ্রা ও পতাকা রয়েছে। রাজধানীর নাম হারগেইসা। তবে সোমালিল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা এখনো বিরোধপূর্ণ। ওই এলাকায় বসবাসকারী অনেক সম্প্রদায়ের মানুষেরা হারগেইসার ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের’ পক্ষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পেতে সোমালিল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত আব্রাহাম চুক্তিতে সই করা দেশ।
সিনেটর টেড ক্রুজসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান পার্টির প্রভাবশালী কয়েক জন সদস্য ইসরায়েল ও সোমালিল্যান্ডের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার। টেড ক্রুজ ওয়াশিংটনের কাছে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সোমালিল্যান্ডকে নিয়ে অবস্থান পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত এখনো পাওয়া যায়নি।