সোনায় মোড়ানো ঘানায় কেন এ করুণ দশা

বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ার প্রতিবাদে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছেন।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ডরিস ওদুরো দুই সন্তানের একা মা। ছোট্ট মনিহারি দোকানের মালিক তিনি। সেই দোকান এখন প্রায় ফাঁকা। ঘানার রাজধানী আক্রার ওডোরকরের ওই পণ্যহীন দোকান নিয়ে তিনি হতাশ। দীর্ঘ ১৫ বছর ব্যবসা করার পর এখন তা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছেন। কারণ, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছেন না তিনি।

৩৮ বছর বয়সী ওদুরো দোকানে জুস, বিস্কুট, কোমল পানীয়, প্রসাধনসামগ্রী, মিষ্টিসহ আমদানিপণ্য বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখন বিশাল ক্ষতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’ কারণ, ঘানায় এখন অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে, যা ওদুরোর ব্যবসায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

ওদুরো বলেন, ‘পণ্যের দাম বাড়ছে, এটা আমার মূলধনকে প্রভাবিত করছে। এ কারণে আমি এখন ব্যবসা বন্ধ করে অন্য কিছু করতে চাই। বিষয়গুলো আমার জন্য অনেক কঠিন। কারণ, আমি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারছি না। আর আমার একটি পরিবারও আছে।’

বিশ্বব্যাংক একসময় তেল, কোকো ও সোনায় সমৃদ্ধ ঘানাকে আফ্রিকার উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল। ২০১৯ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ হওয়ার পর বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি ছিল দেশটির। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম আফ্রিকায় অর্থনীতির দিক দিয়ে দেশটির আর কোনো পরিচয় নেই। কোকো ও সোনা রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশটি সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। ঘানায় বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড ৫০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা গত ২১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ঘানা বর্তমানে অর্থনীতির বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। কারণ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে নেওয়া ঋণ এখন আর শোধ করতে পারছে না দেশটি।

অর্থনৈতিক সংকটে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঘানার অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-অ্যাডো ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ঘানার অর্থনৈতিক সাফল্য সবার চোখে পড়ে। তিনি মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে এনেছিলেন। ২০১৬ সালে আগের সরকারের সময় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৫ দশমিক ৪। ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ এই হার ৭ দশমিক ৯–এ নেমে আসে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা মহামারির আগপর্যন্ত তা এক সংখ্যায় স্থির ছিল। প্রেসিডেন্ট আকুফো ক্ষমতায় আসার আগে দেশটির বাজেট ঘাটতি ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯ সালের শেষের দিকে তা ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে।

আক্রাভিত্তিক পলিসি ইনিশিয়েটিভ ফর ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টের অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল আনিম অমর্তেয় বলেন, ‘২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আমরা যে প্রবৃদ্ধি দেখেছি, তা মূলত তেল খাত থেকে এসেছে।অর্থনীতির উন্নতি দেখে আমরা আনন্দিত ছিলাম, কিন্তু সঠিক কৌশলে এগোতে পারিনি। কারণ, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অন্যান্য খাতকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ আমরা কৃষি খাতকে অবহেলা করেছি। এই খাতে আমরা তেমন কোনো বিনিয়োগ করতে পারিনি। অথচ সরকার আত্মতুষ্টিতে ছিল।’

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঘানার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, ঘানার জিডিপির ২১ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে কৃষি খাত। যা এর রপ্তানি আয়েরও ৪০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে এই খাত দেশের মোট চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি খাদ্য সরবরাহ করে।

ড্যানিয়েল আনিম বলেন, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার বহু বছর থেকে কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোকো উৎপাদনে প্রধান দেশ হলেও আমরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিইনি।’

দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন, ঘানার এমন ব্যবসায়ীরা পশ্চিমা দেশ ও চীন থেকে আমদানি করা পণ্য কেনা-বেচা করেন। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে—গৃহস্থালি সামগ্রী, ভোগ্যপণ্য, গাড়ি ও পুরোনো কাপড়। এসব পণ্য আমদানির জন্য তাঁদের বিপুল পরিমাণ ডলারের প্রয়োজন হয়। স্থানীয় মুদ্রা সেডির মূল্য বিশ্ববাজারে অনেক কমে গেছে। এ কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘানার নাগরিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় অবর্ণনীয়ভাবে বেড়ে গেছে।

বন্দরগুলোতে এখন আমদানি শুল্ক অনেক বেশি। এ কারণে আমাদের এই বাড়তি বোঝা খুচরা বিক্রেতাদের ওপর চাপাতে হবে। এতে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে। এর ফলে ঘানায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি কোনোভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারছে না।
ফ্রান্সিস অ্যানিম, ঘানায় যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিকারক

যানবাহনের খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিকারক ফ্রান্সিস অ্যানিম বলেন, ‘গত বছরের শুরুর দিকে স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে খাবার বাবদ রোজ পাঁচ ডলার খরচ করতাম। এখন একই পরিমাণ খাবারের জন্য প্রায় ১০ ডলার খরচ করতে হচ্ছে। কেন?’

ফ্রান্সিস অ্যানিম আরও বলেন, ‘বন্দরগুলোতে এখন আমদানি শুল্ক অনেক বেশি। এ কারণে আমাদের এই বাড়তি বোঝা খুচরা বিক্রেতাদের ওপর চাপাতে হবে। এতে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে। এর ফলে ঘানায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি কোনোভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারছে না।’

চরম সংকটে দেশ

সম্প্রতি ঘানার প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে বলেছেন, পশ্চিম আফ্রিকার দেশটি এখন সংকটে আছে। এই পরিস্থিতির জন্য তিনি করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করেছেন।

তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই দেশের এই পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। এর উদাহরণ হলো—প্রেসিডেন্ট আকুফোর সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রচারাভিযানের প্রতিশ্রুতি পূরণ। তাঁর সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ৯ মাসেই সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বিনা মূল্যে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে খাবারও সরবরাহ করা হয়।

কোকো ও সোনা রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক দশকের মধ্যে ঘানা সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এ ছাড়া ২০১৭ সালে ক্ষমতাসীন নিউ প্যাট্রিয়টিক পার্টি ১৫টি কর বাদ দিয়েছিল। এর মধ্যে আর্থিক পরিষেবা, আবাসন ও নির্ধারিত আমদানি করা ওষুধের ওপর ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে, ১ শতাংশ বিশেষ আমদানি শুল্ক এবং অভ্যন্তরীণ বিমানের টিকিটের ওপর ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট বাতিল করেছে।

মিশিগানে অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ঘানার নাগরিক উইলিয়ামস কোয়াসি পেপ্রাহ বলেন, এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব কমেছে। রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে সরকার ঋণ নিয়েছে। এটি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে ঘানার বন্ড মার্কেট গতিশীল করেছে। এ কারণে উচ্চ ঋণের স্তর অস্থিতিশীল হয়ে গেছে।

২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আকুফোর সরকার ব্যাংকিং খাতে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। সরকারের লক্ষ্য ছিল আস্থা পুনরুদ্ধার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ব্যাংকিং খাতকে পুনঃস্থাপন করা।

ঘানার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা সরকার। এ খাতে মজুরি দিতে বাজেটের প্রায় অর্ধেক ব্যয় হয়। গত বছর আনুমানিক রাজস্ব আয় ছিল ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

উইলিয়ামস কোয়াসি বলেন, এতে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ব্যয় হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে আরও দুটি তেলক্ষেত্র আবিষ্কার হওয়ায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হয়েছিল। অথচ সরকার আরও অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত বন্ড ইস্যু করে ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে।

ঘানার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা সরকার। এ খাতে মজুরি দিতে বাজেটের প্রায় অর্ধেক ব্যয় হয়। গত বছর আনুমানিক রাজস্ব আয় ছিল ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আর সরকারি কর্মীদের বেতন দিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

প্রশিক্ষণার্থী নার্স ও শিক্ষকদের জন্য দুই বছর থেকে বন্ধ হওয়া ভাতা সরকার ২০১৭ সালে চালু করে। এই দুই বছর ধরে ভাতা বন্ধের কারণেই প্রেসিডেন্ট জন মাহামা ২০১৬ সালের নির্বাচনে আকুফোর কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরে নতুন সরকার শুধু নার্সদের ভাতা চালু করে। এ জন্য সরকারকে বছরে ২৫ লাখ ডলারেরও বেশি অর্থ দিতে হয়।

ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-অ্যাডো ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
ফাইল ছবি: এএফপি

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক কোয়াসি ইয়েরেনকি বলেন, ‘এটা ছিল আকুফো সরকারের একটি দুর্বল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ, দেশ তখন রাজস্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। সরকার প্রাপ্তির চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করেছে এবং একই সময়ে করের আওতা বিস্তৃত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে আমরা ধীরে ধীরে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি।’

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ২০২০ সালে রাজস্ব হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর কারণ মূলত করোনা মহামারি। এ সময় সরকার মানবতাবাদী নীতি গ্রহণ করেছিল। মহামারিকালে নাগরিকদের জন্য বিনা মূল্যে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছিল সরকার। এ ছাড়া তিন সপ্তাহের লকডাউন চলাকালে ৪ লাখ ৭০ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে সরকার। এর পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৯৪ লাখ ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘানার ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির প্রায় ৭৬ শতাংশ।

এ ছাড়া ২০২১ সালের আগস্টে ১১১টি হাসপাতাল নির্মাণকাজ শুরু করে সরকার। এর আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। পরে আকুফো সরকার স্বীকার করেছে, এই নির্মাণ প্রকল্প ‘অতি উচ্চাভিলাষী’। রাস্তা, স্কুল ও বাজার নির্মাণের মতো অন্যান্য নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ মোকাবিলায় সরকার ঋণ নিতে থাকে। আর দেশের অর্থনীতি দুর্বল হতে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘানার ঋণের পরিমাণ ৪৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা জিডিপির প্রায় ৭৬ শতাংশ।

গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে স্থানীয় মুদ্রা সেডি তার ৫০ শতাংশেরও বেশি মান হারিয়েছে। এ কারণে ঘানার ঋণের বোঝা ৬ বিলিয়ন ডলার বেড়ে গেছে।
ফাইল ছবি: এএফপি

অর্থনীতিবিদ ড্যানিয়েল আনিম বলেন, ‘আমরা যে ঋণ করেছিলাম, তা বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়নি। যদি তা করা হতো, তাহলে আমরা ঋণ পরিশোধে সক্ষম হতাম। ঋণ নেওয়া খারাপ কিছু নয়, তবে এটি কীভাবে ব্যবহার হবে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দিক থেকে অর্থনীতির পরিচালকেরা এটিকে গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’

গত নভেম্বরে পার্লামেন্টে চলতি বছরের বাজেট বিবৃতিতে ঘানার অর্থমন্ত্রী কেন ওফোরি-আত্তা বলেছেন, তেল রপ্তানিকারক দেশটি গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৯ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে। তাঁরা আফ্রিকার অষ্টম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশের জন্য ৮৭৩ দশমিক ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব এনেছেন। যদিও গত জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে তেলের উৎপাদন কমেছে।

আমরা যে ঋণ করেছিলাম, তা বিচক্ষণতার সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়নি। যদি তা করা হতো, তাহলে আমরা ঋণ পরিশোধে সক্ষম হতাম।
ড্যানিয়েল আনিম, অর্থনীতিবিদ

জনস্বার্থ ও জবাবদিহি কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাম বাড়ার কারণে সরকার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি রাজস্ব গ্রহণ করেছে।

পার্লামেন্টে বিরোধী দলের সদস্য আইজ্যাক আদোঙ্গো প্রশ্ন তুলেছেন, তেলের সব রাজস্ব গেল কোথায়? তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। কারণ, সরকার ক্রমাগত ঋণ করে চলছে। আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এ থেে উত্তরণের উপায় নেই।’

গত মে মাসে ঘানায় ই-কর ব্যবস্থা চালু করা হয়। প্রথম মাসে এতে লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ আদায় করা সম্ভব হয়েছিল।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এত চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও সরকারের প্রত্যাশা ছিল—মহামারির পর অর্থনীতি আগের পর্যায়ে ফিরে আসবে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ঘানার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।

উইলিয়ামস কোয়াসি বলেছেন, ‘যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। অল্প সময়ের মধ্যে ঘানায় দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন অর্থনীতির ক্ষুদ্র ও বৃহৎ স্তরকেও প্রভাবিত করে। দেশের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ব্যাংক অব ঘানার কাছে প্রয়োজনীয় ডলার ছিল না। অর্থ প্রদানের ভারসাম্যের অবনতি ঘটায় দেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’

এদিকে বিদ্যুতের দাম ২৭ শতাংশ ও পানির দাম ২২ শতাংশ বাড়ার প্রতিবাদে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ করেছে। অধিকারকর্মী ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারকেরাও সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলেছেন।

জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানী আক্রার রাস্তায় হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন নারীরাও।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

অ্যারাইজ ঘানা প্রেসার গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী সদস্য বার্নার্ড মোরনাহ বলেন, ‘আমাদের কাছে সোনা, তেল ও কোকো আছে। এই সরকারের সময় দুর্নীতির মাত্রা নজিরবিহীন। সরকারি কর্মকর্তারা রাষ্ট্রীয় তহবিল ও সম্পদ লুটপাট করছেন। তাহলে আমরা কীভাবে উন্নয়ন করব?’

আফ্রিকায় দুর্নীতির ধারণার ওপর ২০২১ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক সমীক্ষায় ৪৯টি সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশের মধ্যে ঘানাকে নবম স্থান দেওয়া হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট

বর্তমানে সরকার তারল্য সংকট মোকাবিলা করায় বিনিয়োগকারীরা অর্থনীতিতে আস্থা হারাতে শুরু করেছেন। তাঁরা অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন। গত মে মাসে অর্থমন্ত্রী ওফোরি-আত্তা একটি অজনপ্রিয় ই-কর ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এর আওতায় রাজস্ব বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইলেকট্রনিক ও মার্চেন্ট পেমেন্ট, ব্যাংক ট্রান্সফার এবং প্রবাসী আয়ের ওপর ১ দশমিক ৫ শতাংশ কর বসিয়েছিল। প্রথম মাসে এতে লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ আদায় করা সম্ভব হয়েছিল।

অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি মুডির মতো ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলো ঘানার অবস্থান নিচে নামিয়ে এনেছে। এ কারণে বিনিয়োগকারীরা আরও দূরে চলে যাচ্ছে। গত জুলাই মাসে ত্রাণের জন্য ঘানা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও আইএমএফের বেল আউট নেওয়ার জন্য পূর্বসূরির নিন্দা জানানোর পর প্রেসিডেন্ট আকুফোর কাছে এটি অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল।

করোনায় তিন সপ্তাহের লকডাউন চলাকালে ৪ লাখ ৭০ হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে সরকার। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ৯৪ লাখ ডলার।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এদিকে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত ডিসেম্বরে আইএমএফের সঙ্গে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি করেছে দেশটি। তবে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তির কারণে বেশ কিছু খাতে ভর্তুকি কমাতে হয় ঘানাকে। এরপর দেশটিতে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। এ কারণে চুক্তির নিন্দা করে ও দেশটির প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চেয়ে রাজধানী আক্রায় বিক্ষোভও করেন দেশটির সাধারণ মানুষেরা।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, গত এক প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দেশটি।

আগে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো ঘানা। সেই ঘানাই এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্রুত শেষ হওয়া আন্তর্জাতিক রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য তার বিদেশি ঋণের অংশে অর্থ প্রদান স্থগিত করেছে। ব্যয় কমানোর জন্য গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে সরকারি খাতে নিয়োগেও স্থবিরতা শুরু হয়েছে।

দেশটির উপপ্রতিমন্ত্রী আবেনা ওসেই-আসারি বলেছেন, ‘গল্পটি অন্য রকম হতে পারত, তবে মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তা হতে দেয়নি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সুস্পষ্ট নীতি তৈরি করেছি। আমরা খুব আশাবাদী, অর্থনীতি আগের পর্যায়ে ফিরবে।’

এদিকে ব্যাংক অব ঘানা বলছে, আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি করার পর থেকে ঘানার অর্থনীতিতে কিছুটা আশার আলো দেখা গেছে। স্থানীয় মুদ্রা সেডির মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে একটু বেড়েছে। গত নভেম্বরের শেষে সেডির মান ছিল ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ। তা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ।

কোকো ও সোনা রপ্তানিকারক দেশ হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক দশকের মধ্যে দেশটি সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উইলিয়ামস কোয়াসি পেপ্রাহসহ অন্য অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হলো, সরকারকে তার সাধ্যের মধ্যে থাকতে হবে।

উইলিয়ামস কোয়াসি আরও বলেন, ‘বর্তমান সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে এবং রাজস্ব বাড়াতে হবে। দায়বদ্ধ থাকতে হবে এবং সম্পদের দক্ষ ও কার্যকর বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।’

ব্যাংক অব ঘানা বলছে, আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি করার পর থেকে ঘানার অর্থনীতিতে কিছুটা আশার আলো দেখা গেছে। স্থানীয় মুদ্রা সেডির মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে একটু বেড়েছে।

ড্যানিয়েল আনিম অমর্তেয় বলেন, দুর্নীতি দমনে সরকারকে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, সরকারি সংস্থাগুলোতে প্রতিটি সেডির হিসাব আছে। বিশেষ কৌঁসুলির অফিসকে ক্ষমতায়িত করা উচিত, যাতে তাঁরা দুর্নীতি মোকাবিলা করতে পারে। সেখানে আর্থিক শৃঙ্খলা থাকতে হবে। এটা হলে কর্মসংস্থান বাড়বে এবং অর্থনীতিও ফিরে আসবে।’

অন্য ঘানাবাসীর মতোই ওডোরকরের মনিহারি ব্যবসায়ী ডরিস ওদুরো আবার একটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি দেখতে চান। যেখানে তিনি আবার ব্যবসা করবেন। সেই অর্থে পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারবেন। ওদুরো বলেন, ‘ভোটার হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এখন সরকারকেও সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে—অর্থনীতি ঠিক করতে হবে। এমন ঘানা আমরা দেখতে চাই না।’

  • রয়টার্স ও আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তর সুজন সুপান্থ