এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পের পর মরক্কোতে চলছে মাতম। ভূমিকম্পের দুই দিন পরও জীবিত ব্যক্তিদের খোঁজে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ। এ ভূমিকম্পে আজ রোববার বিকেল পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানির কথা জানানো হয়েছে।
গত শুক্রবার মধ্যরাতে মরক্কোর মারাকেশ শহর ও এর আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শক্তিশালী এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৮। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো নয়, ওই অঞ্চলেই শত বছরের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প এটি।
মধ্যরাতের সেই ভূমিকম্পের পরই আতঙ্কিত মানুষজন বাড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। সেদিন বাইরেই কাটে তাঁদের। গতকাল শনিবার রাতও ঘরের বাইরেই কাটাতে হয়েছে অনেককে। এদিকে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় ত্রাণ নিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যেতে পারছেন না ত্রাণকর্মীরা।
ভূমিকম্পে বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ধসে অনেক সড়ক যান চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে আসা লোকজনের কেউ কেউ খোলা জায়গা, খেলার মাঠ বা সড়কে তাঁবু গেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। রোগীর চাপ সামলাতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
মরক্কোর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আজ বিকেলে হতাহত ব্যক্তিদের হালনাগাদ হিসাব দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, ভূমিকম্পে তখন পর্যন্ত ২ হাজার ১২ জনের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সরকার। আহত হয়েছেন ২ হাজার ৫৯ জন। তাঁদের ১ হাজার ৪০৪ জনের অবস্থা গুরুতর।
‘স্বজন হারিয়েছেন প্রত্যেকে’
মারাকেশ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম মৌলে ব্রাহিম্য। ভূমিকম্পে নিহত ব্যক্তিদের সমাহিত করতে সেখানে কবর খুঁড়ছিলেন কয়েকজন। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বৌছরা নামের এক নারী। প্রিয়জন হারানোর শোকে ভেঙে পড়া এই প্রবীণ নারী হিজাবে চোখের জল মুছছিলেন।
বৌছরা বললেন, ‘আমি স্বচক্ষে ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছি। মনে হলো, আগুনের একটি গোলা সব গিলে নিল। এই ঘাতক ভূমিকম্পে প্রত্যেকে কোনো না কোনো প্রিয়জনকে হারিয়েছেন।’
মারাকেশ থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম তাফেঘাগতে। ভূমিকম্পে পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। গ্রামটির বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সী ওমর বেনহান্না বলেন, ‘আমার তিন নাতি–নাতনি ও তাদের মা মারা গেছে। এখনো তারা ধ্বংসস্তূপের নিচে। এই তো কয়েক ঘণ্টা আগেও তাদের নিয়ে খেললাম।’
মারাকেশের বাসিন্দা ফাতেমা সাতির বললেন, ভবন ধসে পড়ার ভয়ে অনেকে সড়কে ঘুমাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘দেখুন, লোকজন কোথায় ঘুমাচ্ছে। আমাদের কেউ সাহায্য করছে না। আমাদের বাড়ি ধসে গেছে। অনেকের বাড়ি তো বিধ্বস্ত। আমরা সবাই বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতির মধ্যে আছি।’
মৌলো ব্রাহিমের বাসিন্দা লাহচেন বলেন, ‘(ভূমিকম্পে) আমি সব হারিয়েছি।’ ভূমিকম্পে প্রাণ হারিয়েছে তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তান। ভূমিকম্পে লাহচেনের বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাঁর তিন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়। কিন্ত এখনো স্ত্রী আর ছেলের লাশ পাওয়া যায়নি।
ধ্বংসস্তূপে আটকা অনেকে
মরক্কোর অদূরের পাহাড়ি গ্রাম আসনি। আদীনি মুস্তাফা নামের সেখানকার এক বাসিন্দা বললেন, ‘এখনো অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে। অনেকে এখনো তাঁদের মা–বাবার খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ভূমিকম্পে বড় বড় পাহাড় ধসে পড়ায় সড়কগুলোতে যান চলাচলও বন্ধ।’
মারাকেশের বাসিন্দা লতিফা বলেন, ‘বেশির ভাগ বাড়িঘর, দোকান থেকে শুরু করে প্রায় সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মানুষজন এখনো ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে আছেন। চরম দুর্ভোগে আছেন বাসিন্দারা। কিন্ত এখানকার অনেক বাসিন্দার দুয়ারে এখনো সাহায্যই এসে পৌঁছায়নি।’
ভূমিকম্পে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে জোরালো তৎপরতা চলছে। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, এখনো জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধারের আশা করছেন তাঁরা। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারের অভিযান ত্বরান্বিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে নতুন করে উদ্ধারকর্মী পাঠানো হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের পরিচালক ক্যারোলিন হল্ট আজ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জীবিতদের উদ্ধারে পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুর্গম অঞ্চলগুলোতে উদ্ধার অভিযান জোরদার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এ জন্য ভারী সরঞ্জামেরও প্রয়োজন হবে।