‘চমৎকার’ ইংরেজি কীভাবে শিখলেন আফ্রিকান নেতারা
এ বছরের ৯ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসে বৈঠক চলছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন আফ্রিকার পাঁচটি দেশ লাইবেরিয়া, গ্যাবন, গিনি–বিসাউ, সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার নেতারা।
বৈঠকে একপর্যায়ে ইংরেজিতে বক্তব্য শুরু করেন লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোয়াকাই। তাঁর মুখে সাবলীল ইংরেজি শুনে প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প। জানতে চান, এত সুন্দরভাবে ইংরেজিতে কথা বলা কোথা থেকে শিখেছেন তিনি!
বৈঠকে আফ্রিকার অনেক নেতা নিজ নিজ ভাষায় কথা বলেন। ভাষাগুলো ট্রাম্পকে বোঝানোর জন্য অনুবাদকের ব্যবস্থা ছিল। তবে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোয়াকাই ইংরেজিতে বলেন, ‘লাইবেরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করে তোলার আপনার যে নীতি, তার প্রতি আমাদের আস্থা রয়েছে।’
ইংরেজি ভাষায় বোয়াকাইয়ের দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘খুবই চমৎকার ইংরেজি, খুবই সুন্দর। আপনি কোথা থেকে এত সুন্দরভাবে কথা বলা শিখেছেন? আপনি কোথা থেকে পড়াশোনা করেছেন? লাইবেরিয়া থেকে?’
বোয়াকাইয়ের হ্যাঁ-সূচক জবাব পেয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘এটি চমৎকার ইংরেজি। এই টেবিলে আমি এমন অনেককে পেয়েছি, এর কাছাকাছিও কথা বলতে পারেন না।’
সেদিন ট্রাম্পের মন্তব্যে টেবিলে হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়লেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল গভীর। লাইবেরিয়ার মতো ইংরেজিভাষী একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এ প্রশ্ন আসা অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হয়েছে।
অনেক লাইবেরিয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘আমরা ২০০ বছর ধরে ইংরেজিভাষী। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এমন প্রশ্ন করা স্রেফ অজ্ঞতা।’ তাঁদের কথা, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি লাইবেরিয়ার ইতিহাস সামান্য একটুও জানতেন, তাহলে জোসেফ বোয়াকাইকে ‘আপনার ইংরেজি সুন্দর’, এ কথা হয়তো বলতেন না।
কিন্তু এ ঘটনার সূত্র ধরেই আলোচনায় এসেছে আফ্রিকায় ইংরেজি ভাষার ইতিহাস, রাষ্ট্রপ্রধানদের সাবলীল ইংরেজি উচ্চারণ এবং বিশ্বমঞ্চে তাঁদের ভাষার রাজনৈতিক তাৎপর্য।
তবে ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো আফ্রিকাকে অনেক সময় ‘দুর্বল’ হিসেবে দেখা হয়। আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানেরা বিশ্বমঞ্চে চমৎকার ইংরেজিতে কথা বললেও পশ্চিমা গণমাধ্যম বা রাজনীতিবিদদের বিস্ময় প্রকাশ সেই প্রাচীন উপনিবেশবাদী মনোভাবকেই মনে করিয়ে দেয়।
আফ্রিকার প্রধান ভাষা
আফ্রিকা মহাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পাঁচটি ভাষা হলো আরবি, ইংরেজি, ফরাসি, সোয়াহিলি ও হাউসা। আরবি প্রধানত উত্তর আফ্রিকায় প্রচলিত—মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কো, সুদান ইত্যাদি দেশে। অনেক দেশে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রশাসন, শিক্ষা ও গণমাধ্যমে আরবির গুরুত্ব অপরিসীম।
পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার অনেক দেশে সরকারি ভাষা ইংরেজি। যেমন নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, উগান্ডা ইত্যাদি। সরকার, ব্যবসা ও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়।
পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতে প্রধান ভাষা ফরাসি। যেমন সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি। সরকারি কাজকর্ম, স্কুল, আনুষ্ঠানিক যোগাযোগে ফরাসি ব্যবহৃত হয়।
পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম ভাষা সোয়াহিলি। কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি ও কঙ্গোর কিছু অংশে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকার বহু মানুষের মাতৃভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে প্রচলিত।
হাউসা পশ্চিম আফ্রিকার প্রধান ভাষা, বিশেষ করে নাইজেরিয়া ও নাইজারে। স্থানীয় মানুষের মধ্যে মাতৃভাষা এবং বাণিজ্যিক যোগাযোগের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লাইবেরিয়ার ভাষা-ইতিহাস
বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ট্রাম্প লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্টের ইংরেজির প্রশংসা করেছেন, ঠিক আছে। কিন্তু দেশটি সম্পর্কে তাঁর কিছু তথ্য জানা উচিত।
লাইবেরিয়া আফ্রিকার একমাত্র দেশ, যেটি উনিশ শতকের শুরুতে মুক্ত আফ্রো-আমেরিকানদের দ্বারা গড়ে ওঠে। ১৮২২ সালে আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটির উদ্যোগে দাসপ্রথামুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের বসতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে লাইবেরিয়ার জন্ম। ১৮৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও শাসনব্যবস্থার আদলে গড়ে ওঠে।
এ পটভূমিতেই ইংরেজি হয়ে ওঠে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ভাষা। দেশটির ৩০টির বেশি স্থানীয় ভাষা থাকলেও ইংরেজিই হলো সরকার, আইন, শিক্ষা, সংবাদমাধ্যম—সব ক্ষেত্রের প্রধান ভাষা। রাজধানী মনরোভিয়া থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত শিক্ষিত সমাজে ইংরেজির প্রভাব সুস্পষ্ট।
লাইবেরিয়ার ২৬ জন প্রেসিডেন্টের মধ্যে ১০ জনই যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়ার নামকরণ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট জেমস মনরোর নামে। লাইবেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকা দেখতে কাছাকাছি। এই পতাকার নকশা করেছিলেন সাত কৃষ্ণাঙ্গ নারী, যাঁদের সবার জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। লাইবেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ উইয়াহর ছেলে টিমোথি উইয়াহ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য।
রাষ্ট্রপ্রধান জোসেফ বোয়াকাই ইউনিভার্সিটি অব লাইবেরিয়া থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক। ইউনিভার্সিটি অব লাইবেরিয়া পশ্চিম আফ্রিকার অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে লাইবেরিয়ার বহু রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ পড়াশোনা করেছেন।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, যেহেতু ইংরেজি লাইবেরিয়ার সরকারি ভাষা। বোয়াকাইয়ের প্রজন্ম ইংরেজিকে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অংশগ্রহণের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছে।
আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের ভালো ইংরেজির রহস্য
লাইবেরিয়া ছাড়াও আফ্রিকার আরও অন্তত ২০টি দেশে ইংরেজি সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্তত ২২ কোটি মানুষ ইংরেজি ভাষায় কথা বলেন, যা আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ। এর পেছনে উপনিবেশবাদের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের কারণে নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে, বতসোয়ানা—সব দেশেই প্রশাসন ও শিক্ষার ভাষা হয়ে ওঠে ইংরেজি।
আজকের প্রজন্মের আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানদের অনেকে বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। অনেকেই ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। অনেকেই বিদেশে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফলে তাঁদের ইংরেজি শুধু বই পড়ার ভাষা নয়, কূটনীতি, বাণিজ্য আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সাবলীল হাতিয়ার।
যেমন নাইজেরিয়া আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ। এখানে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভার সবাই আন্তর্জাতিক মঞ্চে খাঁটি ব্রিটিশ বা আমেরিকান উচ্চারণে বক্তব্য দেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা বর্তমান প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বক্তৃতা ইংরেজি ভাষায় বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
স্বাধীন কেনিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জোমো কেনিয়াত্তা থেকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো—সবার ইংরেজি বক্তৃতা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিশেষভাবে আলোচিত।
এ ছাড়া আফ্রিকার বহু দেশে স্থানীয় ইংরেজি উচ্চারণের নিজস্ব ধরন গড়ে উঠেছে। যেমন নাইজেরিয়ান ইংলিশ, সাউথ আফ্রিকান ইংলিশ, কেনিয়ান ইংলিশ। এগুলো ব্রিটিশ ও স্থানীয় ভাষার মিশ্রণে তৈরি এক স্বতন্ত্র উচ্চারণধারা।
আজকের আফ্রিকায় ইংরেজি কেবল একটি ভাষা নয়; এটি অর্থনীতি, কূটনীতি ও শিক্ষার আন্তর্জাতিক সংযোগের প্রতীক। আফ্রিকান ইউনিয়নের বহু বৈঠক হয় ইংরেজিতে। জাতিসংঘে আফ্রিকার প্রতিনিধিরা সাবলীল ইংরেজিতে নিজেদের পক্ষে সওয়াল করেন।
একই সঙ্গে ইংরেজি আফ্রিকার বহুভাষিক সমাজে ঐক্যের সেতু হিসেবেও কাজ করে। নাইজেরিয়ার মতো দেশে যেখানে পাঁচ শতাধিক ভাষা প্রচলিত, সেখানে ইংরেজিই সবার জন্য অভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যম।
ভাষা, পরিচয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি
আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানদের সাবলীল ইংরেজি বিশ্বমঞ্চে তাঁদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। বাণিজ্যচুক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তি রক্ষা মিশন-সব ক্ষেত্রেই তাঁদের স্পষ্ট ও প্রভাবশালী বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে ট্রাম্পের মন্তব্যের মতো ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি পরিচয় ও ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত। যখন কোনো পশ্চিমা নেতা আফ্রিকার কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের ইংরেজি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন, তখন তা অনেক সময় অজান্তেই একধরনের সাংস্কৃতিক শ্রেণিবিন্যাসকে উসকে দেয়।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোয়াকাইয়ের সেই ছোট্ট উত্তর ‘লাইবেরিয়াতেই’আসলে আফ্রিকার দীর্ঘ ভাষা-ইতিহাসের প্রতিধ্বনি। আফ্রিকা আজ আর কেবল ঔপনিবেশিক অতীতের প্রতীক নয়; এটি আধুনিক শিক্ষিত নেতৃত্বের কেন্দ্র, যেখানে ইংরেজি আন্তর্জাতিক যোগাযোগের শক্তিশালী হাতিয়ার।
তবু ভাষা নিয়ে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো বৈষম্যের ছায়া রয়ে গেছে। আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানেরা যখন সাবলীল ইংরেজিতে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেন, তখন সেটিকে বিস্ময়ের কিছু মনে করা আসলে প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গির অবশিষ্টাংশ।
তবে সমালোচকেরা বলেন, ইংরেজির আধিপত্য স্থানীয় ভাষাগুলোর বিকাশে বাধা তৈরি করছে। অনেক তরুণ নিজের মাতৃভাষার চেয়ে ইংরেজিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা ভবিষ্যতে ভাষাগত বৈচিত্র্য কমিয়ে দিতে পারে। যেমন নোবেলজয়ী ব্রিটিশ সাহিত্যিক আবদুলরাজাক গুরনাহ, যিনি তানজানিয়া থেকে এসেছেন। তাঁর মাতৃভাষা সোয়াহিলি। কিন্তু তিনি লেখেন ইংরেজিতে, এ নিয়ে সমালোচনা আছে।
আফ্রিকার রাষ্ট্রপ্রধানেরা ইংরেজি সাবলীলভাবে বলার মাধ্যমে ঐতিহ্য, শিক্ষা ও কূটনীতির মেলবন্ধন প্রদর্শন করেন। এটি তাঁদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে আত্মবিশ্বাসী ও প্রভাবশালী করে তুলেছে। তবে ভাষার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখনো কিছু বৈষম্যের ছায়া রয়ে গেছে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভাষা শুধু যোগাযোগ নয়, এটি ক্ষমতার চিহ্ন, ইতিহাসের সাক্ষী এবং পরিচয়ের শক্তিশালী হাতিয়ার।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, গার্ডিয়ান, সিএনএন