যে উড়োজাহাজ ঘিরে তৈরি হয়েছে রহস্য

উড়োজাহাজ
প্রতীকী ছবি

জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকায় ১৪ আগস্ট যখন একটি রহস্যময় উড়োজাহাজ জব্দ করা হয়, তখন মিসরের অনুসন্ধানী সাংবাদিক করিম আসাদ কাজে ছিলেন। তিনি ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম মাতসাদা২এসএইচের হয়ে কাজ করেন।

করিম যাত্রীসহ জব্দ হওয়া এই উড়োজাহাজ নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে দেখতে পান, এটি সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, ইসরায়েলের তেল আবিব, মিসরের কায়রো এবং লিবিয়ার ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে অবতরণ করেছে।

১৯ আগস্ট মিসরের নিরাপত্তা বাহিনী কায়রোর পূর্বাঞ্চলীয় আল-শুরুক এলাকা থেকে আসাদকে গ্রেপ্তার করেছে। মাতসাদা২এসএইচ কর্তৃপক্ষ বলছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আসাদের স্ত্রীকে হেনস্তা করেছেন। তাঁদের শিশুসন্তানকে হুমকি দিয়েছেন।

অবশ্য আসাদকে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তাকর্মীরা ওই উড়োজাহাজের তথ্য প্রকাশে কেন বাধা দিচ্ছেন? কেন তাঁরা আসাদকে হুমকি দিচ্ছেন? আর এসব কারণেই এই উড়োজাহাজ, এর যাত্রী ও মালামাল নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে।

কোত্থেকে এসেছে উড়োজাহাজ

উন্মুক্ত তথ্যের উৎস এবং অনলাইন ফ্লাইট ট্র্যাকার্সের তথ্য যাচাই করে মাতসাদা২এসএইচ এই উড়োজাহাজের রহস্যময় গতিপথ প্রকাশ করেছে। উচ্চগতির এই উড়োজাহাজ অবাধে নানা অঞ্চল দিয়ে চলাচল করেছে।

তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ উড়োজাহাজ সান ম্যারিনোতে নিবন্ধিত। কিন্তু এটির অফিস রয়েছে দুবাইয়ে। আবার বেলজিয়ামের আন্তোয়ার্প থেকে এ উড়োজাহাজের ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি দেখভাল করা হচ্ছে।

এই উড়োজাহাজের মালিক বিশ্বের বৃহত্তম ফ্লাইটট্র্যাকার প্ল্যাটফর্ম ফ্লাইটঅ্যাওয়ারকে এই উড়োজাহাজে ফ্লাইট ট্র্যাক না করতে বলেছেন। একই সঙ্গে এই ফ্লাইটের যাবতীয় তথ্য স্থগিত রাখারও অনুরোধ করেছিলেন।

উড়োজাহাজ কোথায় কোথায় গিয়েছিল

গত দুই বছরে এই উড়োজাহাজ ৩৬১টি রাউন্ড ট্রিপ দিয়েছে। সাধারণত কায়রো থেকে বিভিন্ন গন্তব্য চলাচল করেছে।

এমনকি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে এই উড়োজাহাজ লিবিয়ার সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে গিয়েছিল।

আবার এই উড়োজাহাজ কায়রো থেকে উড্ডয়ন করে তেল আবিবে অবতরণ করেছে। সেখান থেকে মিসরের রাজধানীতে ফিরে আসার আগে কাতারের দোহায় গেছে।

১৪ আগস্ট জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকার কেনেথ কাউন্দা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজটি থামানো হয়। কায়রোতে রাতে অবস্থানের পর সেখান থেকে জর্ডানের আম্মান হয়ে লুসাকায় অবতরণ করেছিল এই উড়োজাহাজ।

উড়োজাহাজে কারা ছিলেন

ওই উড়োজাহাজের ১৩ যাত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে জাম্বিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। তাঁদের মধ্যে ছয়জন মিসরীয়, চারজন জাম্বিয়ান এবং অন্যরা লাটভিয়া, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনের নাগরিক।

মাতসাদা২এসএইচ এই যাত্রীদের কয়েকজনের পরিচয় বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অপরিচিত কয়েক ব্যক্তি ছিলেন এই উড়োজাহাজে, যাঁরা একটি গোপন নেটওয়ার্কে কাজ করছেন। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে এমনভাবে তাঁরা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন, যা বেশ ধাঁধার জন্ম দিয়েছে।

তাঁদের মধ্যে দু-একজনের পরিচয় খুব সহজেই জানা গেছে। যেমন জাম্বিয়ার নাগরিক শ্যাড্রিক কাসান্দা। তিনি ‘স্বর্ণ মানুষ’ এবং ‘মি. মানি’ হিসেবে বেশ পরিচিত। তিনি প্রায় নিয়মিত এমন সব ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেন, যাতে তাঁর পাশে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ দেখা যায়।

অন্যান্যের মধ্যে মিসর সেনাবাহিনীর একজন মেজর রয়েছেন। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মিসর দূতাবাসে কাজ করেছিলেন। এ ছাড়া রয়েছেন মিসরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক পুলিশ লেফটেন্যান্ট।

মাতসাদা২এসএইচের প্রকাশিত গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের নামের তালিকায় আরেকজন হচ্ছেন মাইকেল আদেল বটরশ। যুক্তরাজ্য সরকারের নিবন্ধন থেকে জানা যায়, ৪২ বছর বয়সী এই মিসরীয় নাগরিক কাতারে বসবাস করেন। তিনি অ্যামস্টোন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের পরিচালক।

এ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, তারা অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির ব্যবসা করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, পোল্যান্ড, গ্রিস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে এ প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে।

উড়োজাহাজে কী ছিল

জব্দ করার পর জাম্বিয়ার ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট কমিশন (ডিইসি) উড়োজাহাজের ভেতরে তল্লাশি চালায়। প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতি থেকে জানা যায়, তারা ১৩ আগস্ট স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টায় তথ্য পায়, কেনেথ কাউন্দা বিমানবন্দরে অবতরণ করা এই উড়োজাহাজে ভয়ানক সব মালামাল রয়েছে।

বিবৃতিতে জানানো হয়, পরদিন ডিইসি ওই উড়োজাহাজে ব্যাগ ও বক্স থেকে নগদ ৫৫ লাখ ডলার জব্দ করা হয়। এ ছাড়া পাঁচটি পিস্তল, সাতটি ম্যাগাজিন ও শতাধিক রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, উড়োজাহাজ থেকে ৬০০ সোনার বার উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো তামা ও দস্তা দিয়ে মোড়ানো ছিল।