উগান্ডায় নির্বাচন ও আফ্রিকার গণতন্ত্রের রূপ

শুরুতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও দীর্ঘ মেয়াদে থাকার ফলে তা আর পূরণ করা হয় না। উগান্ডায় মুসেভিনির প্রায় ৩৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ঘটনাই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

ষষ্ঠ মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে ভোট দিয়েছেন উগান্ডার ইয়োরি মুসেভিনি
ছবি : রয়টার্স

সময়ের সঙ্গে বদলে যায় অনেক কিছু। বন্ধুত্ব পরিণত ও গাঢ় হয়। প্রিয় স্মৃতিগুলো কখনো অম্লমধুর হয়ে ওঠে। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ কি সময়ের সঙ্গে বদল হয়? আফ্রিকার অনেক দেশেই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদের কোনো সীমা থাকছে না। কিন্তু দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি সেই নেতাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে উঠছে।

ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। উগান্ডার ইয়োরি মুসেভিনির কথাই ধরা যাক। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি উগান্ডার ক্ষমতায়। আবার ক্ষমতায় যেতে চান তিনি। ৭৬ বছর বয়সে এসে ষষ্ঠ মেয়াদে ক্ষমতায় যেতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার উগান্ডায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আফ্রিকার সবচেয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার হিসাব করলে দেখা যায়, পরিবার হিসেবে সবার আগে আসে টোগোর জিনাসিংবে, গিনির ওবিআংস ও গ্যাবনের বঙ্গোজ পরিবার। কোনো কোনো পরিবার পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। ব্যক্তি হিসেবে এই তালিকায় সবার আগে আসে ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্ট পল বিয়ার কথা। তিনি চার দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায়। উগান্ডার মুসেভিনি তাঁদের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি কি ভালো ফল এনেছে?

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুরুতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও দীর্ঘ মেয়াদে থাকার ফলে তা আর পূরণ করা হয় না। উগান্ডায় মুসেভিনির প্রায় ৩৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ঘটনাই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

মুসেভিনিকে নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ করছেন পপ স্টার ববি ওয়াইন
ছবি : রয়টার্স

মুসেভিনি ক্ষমতায় আসার পর শান্তি ফেরানো, নির্ধারিত নির্বাচন আয়োজন, অর্থনীতি উদারকরণ ও বাক্‌স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমা সরকার ও দাতাদের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তাঁর অকপটতা ও ভুল স্বীকার করার বিষয়টিতে একধরনের নতুনত্ব ছিল। তবে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পর এখন তিনি স্বৈরশাসকের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা সইতে পারেন না। বিরোধী আন্দোলনকারী ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার, গুলি ও নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে। এবারের নির্বাচনেই তার স্পষ্ট রূপ দেখা যাচ্ছে।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত গণমাধ্যমকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। আফ্রিকা সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, মহাদেশটিতে গৃহযুদ্ধে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে ৯টিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ নির্ধারিত নেই।

আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়োরি মুসেভিনির প্রতিদ্বন্দ্বী পপ স্টার ববি ওয়াইন ও তাঁর সমর্থকদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ভোটে দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্বাচনী সহিংসতা দেখা গেছে। সহিংসতায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৫০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। অনেক বিরোধীদলীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। দেশটির ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিরোধী দলকে নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে ভোট পর্যবেক্ষণে বাধার অভিযোগ উঠেছে।

শুক্রবার নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, মুসেভিনি ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। তিনি ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। কিন্তু এ দাবিকে ‘কৌতুক’ বলেছেন ববি ওয়াইন। তিনিও নির্বাচনে নিজের জয় দাবি করেছেন।

উগান্ডায় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোট অনুষ্ঠিত হয়
ছবি : রয়টার্স

ইকোনমিস্ট বলছে, উগান্ডায় সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই। কোনো দেশের জন্য প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নির্ধারণ ও তা কঠোরভাবে মেনে চলা কেন গুরুত্বপূর্ণ, তার উদাহরণ হতে পারে উগান্ডা।

১৯৯০ সালের দিকে আফ্রিকার প্রায় কোনো দেশেরই প্রেসিডেন্ট কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তার মেয়াদ নির্ধারিত ছিল না। এরপর মেয়াদ শেষে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার নজির স্থাপন করেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্রের ওই ঢেউয়ে আফ্রিকার প্রায় ৫০টি দেশে নতুন সংবিধান পাস হয়। এর মধ্যে ৩০টি সংবিধানে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এখন কাগজে–কলমে আফ্রিকার এক-তৃতীয়াংশ দেশেই এ মেয়াদ নির্ধারিত আছে। কিন্তু অনেক নেতাই এ নিয়ম মানতে চাইছেন না।

আফ্রিকান ইউনিয়ন যদি ক্ষমতার মেয়াদ লঙ্ঘনকারী বা নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, তবে আফ্রিকার গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হতে পারে।

উগান্ডা ২০০৫ সালে ওই আইন বাতিল করে এবং ২০১৭ সালে বয়সের বাধার নিয়মও তুলে দেয়। আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে আফ্রিকার ১৩টি দেশ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদের আইনকে দুর্বল করেছে।

কোনো কোনো আফ্রিকান মনে করেন, প্রেসিডেন্টের মেয়াদ সম্পর্কে আফ্রিকার দেশগুলোকে কথা শোনানো বর্ণবাদী আচরণ। কারণ, চীনে প্রেসিডেন্টের মেয়াদের আইন বিলুপ্ত করা হয়েছে। রাশিয়া ‘নিজের মতো করে’ প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বাড়িয়েছে, জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ পশ্চিমা অনেক নেতার ক্ষেত্রেই এই বিধিনিষেধ নেই।

চার দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন ক্যামেরুনের পল বিয়া
ছবি : রয়টার্স

ইকোনমিস্ট বলছে, দেশগুলোতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন করা গণতন্ত্র সুসংহত হতে পারে। তা না করে আফ্রিকার ক্ষমতাসীনেরা ‘শক্তিশালী হয়ে’ ব্যালটকে অস্বীকার করছে। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন কমিশন, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও মুক্ত গণমাধ্যমকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছে। আফ্রিকা সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, মহাদেশটিতে গৃহযুদ্ধে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে ৯টিতে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ নির্ধারিত নেই। মেয়াদ নির্ধারিত না থাকায় আরও বেশি দুর্নীতির দিকে ঝুঁকছে দেশগুলো।

অধিকাংশ আফ্রিকার দেশ এখন তাদের সংবিধানে ক্ষমতার সীমা আনতে চাইছে। যদিও বর্তমান ক্ষমতাসীন অনেক নেতা এর পক্ষে নন। কারণ, বিরোধীদের চাপ তাঁদের সৎ থাকতে বাধ্য করতে পারে।

আগে আফ্রিকায় অনেক বেশি অভ্যুত্থান ঘটলেও গত ২০ বছরে তা কমেছে। অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে আফ্রিকান ইউনিয়নের (এইউ) নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে বলেই জানেন অভ্যুত্থানকারীরা। আফ্রিকান ইউনিয়ন যদি ক্ষমতার মেয়াদ লঙ্ঘনকারী বা নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতা দখলকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, তবে আফ্রিকার গণতন্ত্র আরও সুদৃঢ় হতে পারে।