‘বিশ্বকে বলুন, আমরা মারা যাচ্ছি’

ইথিওপিয়ার তাইগ্রে অঞ্চলে ঢুকে নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ উঠেছে ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ইরিত্রিয়া সরকার তা অস্বীকার করে আসছে।ফাইল ছবি: এএফপি

আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ার সংঘাতকবলিত তাইগ্রে অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম তেমবিন। এখানেই বাস মোনালিসা আব্রাহার। গত ডিসেম্বরে চরম নৃশংসতার শিকার হন তিনি। প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়ার সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার শিকার হন এ তরুণী (১৮)। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও এখনো সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তাড়িয়ে ফিরছে তাঁকে।

গত ৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। ওই দিনই ইরিত্রিয়ার সেনারা আব্রাহাদের গ্রামে প্রথম ঢোকেন। দুঃসহ সেই ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর সেনাদের একজন আমাকে ভয় দেখাতে গুলি ছোড়ে। তারা আমার হাতে আঘাত করে এবং তারপর আরেকটি গুলি করে। একটি গুলি আমার বাহু ভেদ করে যায়।’ ‘কয়েক ঘণ্টা ধরে আমার হাত দিয়ে রক্ত ঝরে। পরে অস্ত্রোপচারে আমার হাত কাটা পড়ে,’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।

শুধু আব্রাহা নন, ইরিত্রিয়ার সেনাদের এমন নির্মমতার শিকার হয়েছেন তাইগ্রের বহু মানুষ। অথচ ‘স্থানীয়দের সুরক্ষার জন্য’ সরকারি বাহিনীকে সহায়তার নাম করে ইথিওপিয়ায় প্রবেশ করে ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী। ঘটেছে ঠিক উল্টো। রক্ষক হিসেবে ঢুকে ভক্ষকের ভূমিকায় দেখা গেছে তাদের। সেনারা মেতে ওঠেন হত্যা ও ধর্ষণে। এমন কর্মকাণ্ডের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে ইরিত্রিয়ার সেনাবাহিনী।

তাইগ্রের উকরো অঞ্চলে ইরিত্রিয়া ও ইথিওপিয়ার সেনাদের হাতে নিহত ৮১ জনকে গণকবর দেওয়া হয়। সেই গণকবরে স্বজনদের আহাজারি
ফাইল ছবি: এএফপি

বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন তাইগ্রে অঞ্চলে সংবাদমাধ্যমকেও যেতে দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি বিধিনিষেধ শিথিল করায় আল–জাজিরা সেখানে গিয়ে ঘটনা জানতে পেরেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বয়ানে উঠে আসছে ইরিত্রিয়ার সেনাসদস্যদের ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র।

আবি আহমেদের নেতৃত্বাধীন ইথিওপিয়ার সরকার ইরিত্রিয়ার সেনাদের নৃশংসতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ২০১৮ সালে আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আফ্রিকার এই দেশে রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন শুরু করেন। প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটে তাঁরই হাত ধরে। ফলে ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় নোবেল শান্তি পুরস্কার পান আবি।

ঘটনার শুরু গত বছরের নভেম্বরে প্রথম দিকে। কয়েক মাসের উত্তেজনার পর ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ দেশটির উত্তরাঞ্চল তাইগ্রের ক্ষমতাসীন দল তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে (টিপিএলএফ) উৎখাতে সেনা অভিযানের ঘোষণা দেন। কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে কয়েক দফা হামলার পর ওই অভিযানের নির্দেশ দেন তিনি। ২০১৮ সালে আবি ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত কয়েক দশক ইথিওপিয়ার রাজনীতিতে আধিপত্য ধরে রেখেছিল টিপিএলএফ। ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ১৯৯৮-২০০০ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল তারাই।

প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও বাসিন্দারা আল–জাজিরাকে বলেছেন, ইরিত্রিয়ার সেনারা ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীকে সহায়তার নামে তাইগ্রে অঞ্চলে প্রবেশ করে দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষের ওপর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন।

তাইগ্রে অঞ্চলে বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে পানি সংগ্রহের জন্য ভিড়
ছবি: ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি

ইরিত্রিয়ার সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে তাইগ্রের পশ্চিমাঞ্চলীয় মাই কাদ্রা থেকে বাস্তুচ্যুত আরেক নারী সাবা জানান, কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে তিনিও গ্রাম ছেড়ে পালানোর জন্য বের হয়েছিলেন। কিন্তু পথে ধরা পড়ে যান ইরিত্রিয়ার সেনাদের হাতে। সাবা বলেন, ‘১০ জনের বেশি সেনা পালাক্রমে আমাদের ধর্ষণ করেছে।’
মাই কাদ্রার আরেক নারী বলেন, ইরিত্রিয়ার সেনারা তাঁর স্বামীকে হত্যা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকে বলুন, আমরা মারা যাচ্ছি।’

এই মাই কাদ্রা অঞ্চলেই গত ৯ নভেম্বরে আনুমানিক ৬০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, যার জন্য তাইগ্রের একটি যুব সংগঠন, পুলিশ ও মিলিশিয়াদের দায়ী করা হচ্ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনেও তাইগ্রে অঞ্চলে ইরিত্রিয়ার সেনাদের নৃশংসতার কথা উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেম্বরে তাইগ্রের আক্সুম শহরে কয়েক শ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছেন ইরিত্রিয়ার সৈন্যরা। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বহু ঘটনাও ঘটেছে।

তারা আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে এবং মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর সেনাদের একজন আমাকে ভয় দেখাতে গুলি ছোড়ে। তারা আমার হাতে আঘাত করে এবং তারপর আরেকটি গুলি করে। একটি গুলি আমার বাহু ভেদ করে যায়।
মোনালিসা আব্রাহা, নৃশংসতার শিকার তরুণী

প্রত্যক্ষদর্শী ও নির্যাতনের শিকার ৪১ জনের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে অ্যামনেস্টি। তাঁরা সবাই তাইগ্রিয়ান জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। প্রতিবেদনটির লেখক জ্যঁ-ব্যাপটিস্ট গ্যালোপিন বলেন, স্নাইপার রাইফেল ও মেশিনগান দিয়ে তাইগ্রের রাজপথে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছেন ইরিত্রিয়ার সেনারা।

তাইগ্রেতে ইরিত্রিয়ার সেনারা হত্যা ও লুটপাট চালিয়েছেন বলে সেখানে আবি আহমেদের নিয়োগ দেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নর মুলু নেগাও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটেছে।’ টিপিএলএফের কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীর ওপর হামলাই এখানে ইরিত্রিয়ার সেনাদের আসার পথ করে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

তবে আবি আহমেদের নেতৃত্বাধীন ইথিওপিয়ার সরকার ইরিত্রিয়ার সেনাদের নৃশংসতার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। ২০১৮ সালে আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আফ্রিকার এই দেশে রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন শুরু করেন।

প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটে তাঁরই হাত ধরে। ফলে ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় নোবেল শান্তি পুরস্কার পান আবি। প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আবি আহমেদ প্রশংসিত হলেও নিজ দেশের উত্তেজনাপূর্ণ অঞ্চল তাইগ্রেতে শান্তি ফেরাতে তেমন পদক্ষেপ নেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। উল্টো ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের নামে তাইগ্রের অধিবাসীদের কোণঠাসা করে ফেলার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। তাইগ্রেতে নভেম্বর থেকে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

সেখানে এখন রীতিমতো মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। চলছে খাবার, পানি আর ওষুধের তীব্র সংকট। মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন আবাস হারানো হাজারো উদ্বাস্তু। এ অঞ্চলে ইরিত্রিয়ার সেনাদের নৃশংসতার অভিযোগ ওঠার পর নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সংকট নিরসনে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।