যে কারণে বন্ধু হারাচ্ছে শান্তিতে নোবেলজয়ী আবির ইথিওপিয়া

ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ
ছবি: রয়টার্স

৪ অক্টোবর ২০২১। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় সাজ সাজ রব। রাজধানীর মেসকেল স্কয়ারে এখন পর্যন্ত যতগুলো বড় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, তার একটি ছিল এদিন।

কোথাও চলছিল সামরিক কুচকাওয়াজ। কোথাও আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদিন আদ্দিস আবাবা এতটাই জমকালো সাজে সেজেছিল যে এই আয়োজনকে প্রেসিডেন্টের শপথ কিংবা রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান ভেবে বসার সুযোগ ছিল যে কারও জন্য।

প্রকৃতপক্ষে এই আয়োজনের কেন্দ্রে ছিলেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় দফায় তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন ছিল এটি।

২০১৮ সালে তুমুল বিক্ষোভের মুখে আবির পূর্বসূরি পদত্যাগ করেন। তারপর আবি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিকে বিরোধীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালান আবি। তিনি ইরিত্রিয়ার সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি করেন। যার জন্য ২০১৯ সালে তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

তবে পরবর্তী সময়ে আবির সরকার জাতিগত অস্থিরতার মুখে পড়ে। বিশেষ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় তাইগ্রে রাজ্যের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ ইথিওপিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নড়বড়ে করে দেয়।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৪ অক্টোবর দ্বিতীয় মেয়াদে পাঁচ বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব শুরু করেন আবি।

আবির ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে যে বা যাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁদের প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্যই ৪ অক্টোবর আদ্দিস আবাবায় জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত তাইগ্রেয়ান পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টের (টিপিএলএফ) প্রতি এটা ছিল সমুচিত জবাব।

৪ অক্টোবরের আয়োজনে শামিল হওয়া উল্লসিত জনতার উদ্দেশে আবি বলেন, ‘আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি।’

ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে জনগণ সত্যিকার অর্থে যে রায় দিয়েছে, তার ভিত্তিতেই ক্ষমতার নতুন মেয়াদ শুরু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন আবি।

বিরোধীদের বয়কটের ডাকের পাশাপাশি সহিংসতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভোট হয়নি। ফলে আবি যে দাবি করছেন, ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে জনগণের সত্যিকার রায়ে তিনি জয়ী হয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, যতগুলো আসনে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশের বেশি আসনে জয় পেয়েছে আবির প্রোসপারিটি পার্টি।

আদ্দিস আবাবায় আবির বিশাল অনুষ্ঠান আয়োজনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

কয়েক দশক ধরে ইথিওপিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে বলেছে, যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনা শুরু না করে, সরকারিভাবে অবরুদ্ধ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করতে না দিলে ব্যবস্থা নেবে তারা। এ ক্ষেত্রে তাইগ্রেতে যুদ্ধে জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।

জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস গত ২৯ সেপ্টেম্বর সতর্ক করে বলেন, সংকটপূর্ণ এলাকায় খাদ্য সরবরাহ করা না হলে লাখো মানুষকে অনাহারে ভুগতে হবে।

মার্টিন গ্রিফিথসের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইথিওপিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনেন আবি। একই সঙ্গে তিনি তাঁর দেশ থেকে জাতিসংঘের সাতজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করেন।

আদ্দিস আবাবার অনুষ্ঠানে আবি ঘোষণা দেন, ইথিওপিয়া কখনো বিদেশি চাপের কাছে নতিস্বীকার করবে না।

অতীতে ইথিওপিয়া অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টায় ছিল। তারা আন্তর্জাতিক প্রভাব অর্জনের চেষ্টা করেছিল।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার অর্থনৈতিক জোট আইজিএডিকে তখন নেতৃত্ব দিত ইথিওপিয়া। অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় জাতিসংঘে অনেক বেশি শান্তিরক্ষী পাঠিয়েছিল তারা।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল ইথিওপিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের একনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে উঠেছিল দেশটি।

ওয়াশিংটনে ইথিওপিয়ার একটা প্রভাব ছিল। যার কারণে ২০০৬ সালে সোমালিয়ার তৎকালীন সরকার উৎখাতে আদ্দিস আবাবা আগ্রাসনে সহযোগী হিসেবে যোগ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

তবে এখনকার চালচিত্র খুব ভিন্ন। ইরিত্রিয়ার স্বৈরশাসক ইসাইয়াস আফওয়ার্কির সঙ্গে আবির ঘনিষ্ঠ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আইজিএডিতে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।

সুদানের সঙ্গে ইথিওপিয়ার সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। সম্পর্কের এই তিক্ততার জেরে দুই দেশের সীমান্তে সংঘাত পর্যন্ত বেধেছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ইথিওপিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে।

ইথিওপিয়ায় প্রায় নিয়মিত কথিত বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ হয়। দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কথিত বিদেশি শত্রুদের নিয়মিত নিন্দাবাদ করেন।

ইথিওপিয়ায় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা জোরেশোরে প্রচার করা হয়। এসব তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র টিপিএলএফের যোদ্ধাদের খাদ্য হিসেবে ‘এনার্জি বিস্কুট সরবরাহ করছে। অথবা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা টিপিএলএফের যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র পাচার করছে। এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আলোকে গত আগস্টে দুটি বিদেশি সহায়তা সংস্থার কার্যক্রম ইথিওপিয়ায় স্থগিত করে দেশটির সরকার।

অন্য দেশগুলো থেকে ইথিওপিয়ার ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পেছনে তিনটি বিষয় কাজ করছে। প্রথমটি হলো, পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে আবির খামখেয়ালি দৃষ্টিভঙ্গি। এ ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর জোর দিচ্ছেন। তিনি তাঁর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কোণঠাসা করে রেখেছেন। তিনি বেশ কিছু দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছেন, অথবা দূতাবাসের এখতিয়ার কমিয়ে দিয়েছেন।

আবি অনেকগুলো প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রাখেননি। ফলে বিদেশি নেতারা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

অন্য দেশ থেকে ইথিওপিয়ার ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার পেছনের দ্বিতীয় কারণটি হলো পশ্চিমাদের দ্বৈতনীতি। ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ইথিওপিয়ান সরকারে টিপিএলএফের আধিপত্য ছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেই মিত্রের মানবাধিকার লঙঘনের বিষয়ে নিশ্চুপ ছিল।

ইথিওপিয়ার আইনজীবী জেলালেম মোগেস বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্ব টিপিএলএফকে শক্তিশালী করেছে। শুধু তা-ই নয়, তারা টিপিএলএফের অতীতের অপকর্ম মুছে দিয়েছে।’

নীলনদের ওপর বড় বাঁধ তৈরি করাকে কেন্দ্র করে ইথিওপিয়ার সঙ্গে মিসর ও সুদানের বিবাদ রয়েছে। এই বিবাদে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন মিসর ও সুদানের পক্ষে অবস্থান নেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এক কূটনীতিকের ভাষ্য, ‘আবি সত্যিকার অর্থে বিশ্বাস করেন যে যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে উৎখাতের চেষ্টা করছে।’

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে মতবিরোধ। এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় এক কূটনীতিক বলেন, ‘আমাদের চাওয়া খুবই সহজ। আর তা হলো, যুদ্ধের সমাপ্তি টানা এবং আমাদের সম্পর্কের অপেক্ষাকৃত একটি ভালো সংজ্ঞা তৈরি করা।’

আফ্রিকা অঞ্চলের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। তবে আপাতদৃষ্টে তাঁরাও একই রকম মনোভাব পোষণ করেন।

পশ্চিমারা সহায়তা বন্ধ করে দিলে রাশিয়া ও চীন এগিয়ে আসবে বলে মনে করছেন আবি। কিন্তু আবিকে নিয়ে তাদের মধ্যেও খুব একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার বিরোধিতা করেছে রাশিয়া ও চীন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞারও বিরোধিতা করেছে। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো দেশই আবিকে প্রকৃত সহায়তার প্রস্তাব দেয়নি।

দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে ফাহমিদা আক্তার