আফগানিস্তানে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদের কী হবে?
দীর্ঘ ২০ বছর পর আবার তালেবানের দখলে আফগানিস্তান। আগে থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটিতে তালেবানের শাসন রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। লম্বা সময় ধরে তালেবানের শাসন চললে আফগানিস্তানে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদের কী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আফগানিস্তান বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবে ২০১০ সালে মেলে সুসংবাদ। মার্কিন সেনাবাহিনী ও ভূতাত্ত্বিকেরা জানান, আফগানিস্তানে রয়েছে খনিজ সম্পদের বিপুল ভান্ডার। দেশটির প্রদেশগুলোতে যেমন ছড়িয়ে রয়েছে লোহা, তামা ও সোনা, তেমনই রয়েছে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় নানা মূল্যবান পদার্থ।
আফগানিস্তানে খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অতি মূল্যবান লিথিয়াম। বলা হচ্ছে, লিথিয়ামের বিশ্বের সবচেয়ে বড় খনিটি দেশটিতে রয়েছে। লিথিয়াম রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির মূল একটি উপাদান। এ কারণেই, জলবায়ু সংকট মোকাবিলার এই যুগে এসে খনিজটির চাহিদা আকাশ ছুঁয়েছে। বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানের সব খনিজ সম্পদের মোট মূল্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
এই খনিজ সম্পদের বিষয়ে কথা বলেছেন ইকোলজিক্যাল ফিউচার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রড স্কুনোভার। নিরাপত্তা বিশ্লেষকের পাশাপাশি তিনি একজন বিজ্ঞানী। রড বলেন, নানা কারণে এত দিন আফগানিস্তানের এই খনিজ সম্পদ সেভাবে উত্তোলন করা হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে দেশটিতে নিরাপত্তার অভাব, খনিজ উত্তোলনের সক্ষমতার অভাব এবং একের পর এক খরার মতো কারণগুলো। তালেবানের অধীনেও এ পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এই সম্পদের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান ও ভারত।
আফগানিস্তানের জন্য সম্ভাবনা
আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক দুর্দশা নতুন নয়। দেশটি মূলত বিদেশি সহায়তার ওপর চলছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ সরকারঘোষিত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এমন প্রেক্ষাপটে এই খনিজ সম্পদ আফগানিস্তানের জন্য একটি আশীর্বাদ হতে পারে।
জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন প্রতিরোধ করতে প্রয়োজন কার্বন নিঃসরণ কমানো। এ জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক গাড়ি এবং কার্বন নিঃসরণ কম হয়, এমন প্রযুক্তির ওপর। এ কাজে যে পদার্থগুলো প্রয়োজন তার মধ্যে রয়েছে লিথিয়াম, কোবাল্ট ও নিওডিমিয়াম। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা চলতি বছরের মে মাসে জানায়, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় লিথিয়াম, তামা, নিকেল, কোবাল্টসহ নানা পদার্থের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে বিশ্বের ৭৫ শতাংশ লিথিয়াম, কোবাল্টসহ দুর্লভ খনিজগুলোর চাহিদা মেটাচ্ছে চীন, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো ও অস্ট্রেলিয়া।
এখন পর্যন্ত লিথিয়ামের সবচেয়ে বড় মজুত রয়েছে লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায়। মার্কিন সরকারের হিসাব বলছে, আফগানিস্তানের লিথিয়ামের পরিমাণ বলিভিয়াকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত বছর একটি সাময়িকীতে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) কর্মকর্তা সাইদ মিরজাদ বলেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি যদি কিছু বছরের জন্য শান্ত থাকে, আর এ সময়ে যদি দেশটিতে খনিজ উত্তোলন ব্যবস্থার উন্নতি করা যায়, তাহলে আফগানিস্তান এক দশকের মধ্যে এই অঞ্চলের অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হবে।
বাধার শেষ নেই
আফগানিস্তানে খনিজ উত্তোলনের পথ এতটা সুগম নয়। মার্কিন চিন্তক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক মোসিন খান বলেছেন, দেশটির খনিজ সম্পদের বেশির ভাগই উত্তোলন করা হয়নি। আফগানিস্তানের লোহা, তামা ও সোনার কিছু অংশ তোলা হয়েছে। তবে লিথিয়ামসহ অন্য বহুমূল্য খনিজগুলো উত্তোলন করতে বিশাল বিনিয়োগ, আধুনিক প্রযুক্তি ও সময় প্রয়োজন। কোনো খনিজের খনি আবিষ্কারের পর থেকে তা উত্তোলন শুরু করতে গড়ে ১৬ বছর লেগে যায় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা।
মোসিন খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানে প্রতিবছর ১ বিলিয়ন ডলারের খনিজ উত্তোলন করা হয়। তবে এই অর্থের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশই চলে যায় দুর্নীতিবাজদের পকেটে। দুর্নীতিকে একটি বড় বাধা হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এদিকে ক্ষমতা দখলের পর তালেবান আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ উত্তোলনের দিকে মন দিতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে। তবে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ তাদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে ধারণা মোসিন খানের। তিনি বলেন, তালেবান ক্ষমতা দখলের আগেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আফগানিস্তানের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। এখন তা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। মোসিন প্রশ্ন রাখেন, ‘আগেই যারা আফগানিস্তানে বিনিয়োগ করেনি, তারা এখন করবে কেন? বিনিয়োগকারীরা নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলতে চাইবে না।’
মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও তালেবানের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী সংস্থার তকমা দেয়নি, তবে মার্কিন রাজস্ব বিভাগের ‘বিশেষভাবে মনোনীত বৈশ্বিক সন্ত্রাসীর’ তালিকায় তালেবানের নাম রয়েছে। এতে বিনিয়োগ পেতে সমস্যার মুখে পড়তে পারে তালেবান।
চীনের জন্য সুযোগ?
দুষ্প্রাপ্য খনিজ উত্তোলনে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে চীন। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই যোগাযোগ রেখে চলেছে চীনের সঙ্গে। এই যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে বলে গত সোমবার জানিয়েছে চীন। তাই আফগানিস্তানের খনিজের দিকে দেশটি হাত বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
ইকোলজিক্যাল ফিউচার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রড স্কুনোভার জানান, চীন পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উন্নয়নে কাজ করছে। এ কাজে লিথিয়াম ও অন্য দুষ্প্রাপ্য খনিজগুলোর বিকল্প নেই। তাই চীনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাগুলোর মধ্য এসব খনিজের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
তবে চীনের নজর আফগানিস্তানের দিকে নেই বলে মনে করেন মোসিন খান। তিনি বলেন, এর আগেও আফগানিস্তানে তামা উত্তোলনে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল চীন। তবে শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। এ কারণে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে চীন তালেবানের সঙ্গে এক হয়ে খনিজ উত্তোলনে অংশ নিতে চাইবে না বলে মনে করেন তিনি।
সিএনএন অবলম্বনে শেখ নিয়ামত উল্লাহ