আফগান ঐতিহ্যের স্থাপনা তালেবান রাখবে তো?

২০০১ সালে বুদ্ধের দুটি মূর্তি গুঁড়িয়ে দেয় তালেবানছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের মসনদ এখন তালেবানের দখলে। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। হাজারো মানুষ পালিয়েছেন দেশ ছেড়ে। যারা রয়ে গেছেন, তাঁদের অনেকেই দিন কাটাচ্ছেন অনিশ্চয়তায় আর আতঙ্কে। বিশেষ করে যাঁরা তালেবানের আদর্শকে ধারণ করেন না, পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তাঁদের জন্য সবচেয়ে কঠিন। বেশি অনিশ্চয়তায় রয়েছেন নারীরা। শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে নারীদের যে বিচরণ গত কয়েক বছরে ঘটেছে, তাতে ছেদ পড়েছে। নারী অধিকার রক্ষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও বিশ্বের নানা দেশ। হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীরা।

বদল এসেছে আফগানিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি—সবকিছুতেই। ভেঙেচুরে গেছে দেশটির অর্থনীতি। এসব বড় বদল সহজেই টের পাওয়া যায়। তবে এসব বড় বদলের সঙ্গে দেশটি থেকে অনেক কিছু হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক কিছু। যেমন আফগানিস্তানে সাংস্কৃতিক চর্চাকেন্দ্রগুলো বন্ধের খবর বিভিন্ন সময়ে এসেছে গণমাধ্যমে।

বামিয়ানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি উদ্বোধনের কথা ছিল গত মাসে। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর থেমে গেছে এর কাজ।
ছবি: এএফপি

সম্প্রতি বিবিসির খবরে জানা গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে কাবুলের আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক (এএনআইএম)। গত আগস্টের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায় গানের এই স্কুল। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক আহমদ সরমাস্ট একজন আফগান। তিনিই প্রথম আফগান, যিনি অস্ট্রেলিয়ায় সংগীত বিষয় নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। গত জুলাই মাসেই আফগানিস্তান ছেড়েছেন তিনি। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মতো দেশটির ঐতিহ্য, স্থাপনা, পুরাকীর্তির সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

২০ বছর আগে তালেবান ক্ষমতায় থাকাকালে আফগানিস্তানে একের পর এক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। ২০০১ সালের মার্চে ১ হাজার ৫০০ বছরের প্রাচীন বুদ্ধের দুটি মূর্তি গুঁড়িয়ে দেয় তালেবান। কয়েক সপ্তাহ ধরে এসব মূর্তি ধ্বংসের কাজ চলে। কাবুল থেকে ১৭৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বামিয়ান এলাকায় এই মূর্তিগুলো রাখা ছিল। ইতিহাসবিদেরা বলছেন, এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট সাংস্কৃতিক অপরাধ। এ ঘটনার পর তালেবানের উগ্রবাদী আদর্শ বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়। ৯/১১–তে টুইন টাওয়ারে হামলার মাত্র কয়েক মাস আগেই এ ঘটনা ঘটে।

২০ বছর আগে যা ঘটেছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ইউনেসকোর সংস্কৃতিবিষয়ক সহকারী মহাপরিচালক আর্নেস্টো ওটোন। এর যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, অতীতের কার্যকলাপ দিয়ে বর্তমানকে মূল্যায়ন করা যায়।

আফগানিস্তানে নিযুক্ত ফ্রান্সের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিনিধিদলের পরিচালক ফিলিপ মারকুইস এএফপিকে বলেন, ভবিষ্যতে এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কাবুলের দক্ষিণ–পূর্বে মিস এ আইনাক এলাকায় অবস্থিত বৌদ্ধমন্দির
ছবি: এএফপি

এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশের রাজধানী বামিয়ানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটির কথা। গত মাসেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটিতে লাল গালিচা অনুষ্ঠানের কথা ছিল। তবে তালেবান আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর সে অনুষ্ঠান পিছিয়ে দেওয়া হয়। ২০ বছর আগে তালেবান ঐতিহ্যবাহী এ স্থানেই বুদ্ধের প্রাচীন মূর্তিগুলো ধ্বংস করেছিল।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর কর্মকর্তা ফিলিপ ডেলানঘে বলেন, সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। এখন তাঁরা নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন।

তালেবানের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখা কঠিন

গত ফেব্রুয়ারিতে তালেবানের দেওয়া ঘোষণা অবশ্য ছিল ইতিবাচক। ওই ঘোষণায় তালেবান বলেছে, আফগানিস্তানের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেশটির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশ। এসব নিদর্শন সুরক্ষিত রাখা সবার দায়িত্ব। তবে শঙ্কার কথা হলো অন্তবর্তী সরকার গঠনের পর এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয়ে কিছুই বলেনি তালেবান সরকার।

কাবুলের জাতীয় জাদুঘরের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে
ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে কাবুলের দক্ষিণ–পূর্বে মিস এ আইনাক এলাকায় অবস্থিত বৌদ্ধমন্দির। আছে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় থাকা দ্বাদশ শতকের মিনারাত অব জাম (জামের মিনার)।

আফগানিস্তানের এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বামিয়ানের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, তালেবান সেখানকার হাজারা গোষ্ঠীর এক নেতার মূর্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৯০–এর দশকে ওই নেতাকে হত্যা করেছিল তালেবান। এ অভিযোগের সত্যতা অবশ্য এএফপি নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে মাথা ভেঙে যাওয়া ওই মূর্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সুরক্ষিত রাখতে তালেবানের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না অনেকেই। বামিয়ানে ইউনেসকোর সাবেক কর্মী ছিলেন মুস্তফা। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর অন্যদের সঙ্গে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। জার্মানিতে শরণার্থী হয়ে রয়েছেন। তিনি জানান, তালেবান অমুসলিমদের মূর্তি ধ্বংস করাকে গর্বের কাজ বলে মনে করে।

বামিয়ান সরকারের এক কর্মী আরও ভয়ংকর তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলছেন, আগস্টের শুরুতে বামিয়ান দখলে নেওয়ার পর তালেবান সাংস্কৃতিক বিভাগের শিল্পকর্ম ও বাদ্যযন্ত্র নষ্ট করে দিয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এসব ঘটনায় তিনি দুঃখ পেলেও প্রতিবাদ করতে পারেননি।

কাবুলের জাদুঘর নিয়ে শঙ্কা

কাবুলের জাতীয় জাদুঘরের সুরক্ষা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান ক্ষমতায় থাকার সময় এ জাদুঘরে লুটতরাজ চলে। শেষ পর্যন্ত সেটি রক্ষা করা সম্ভব হয়। ইরাক ও সিরিয়া যুদ্ধে উগ্রবাদীরা কালোবাজারে শিল্পকর্ম বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করেছে। অনেকের আশঙ্কা এবারও তালেবান একই উদ্দেশ্যে জাদুঘরে লুটতরাজ চালাতে পারে। তবে তালেবানের ক্ষমতায় আসতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অনেকটা নির্বিঘ্নে লড়াই, সংঘর্ষ ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। এ পর্যন্ত জাদুঘরটি সুরক্ষিত রয়েছে।

কাবুল জাদুঘরে রক্ষিত হাজারো পুরাকীর্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ তালিকাভুক্ত রয়েছে। কাবুল জাদুঘরের পরিচালক মোহাম্মদ ফাহিম রহিমি নিউইয়র্ক টাইমসকে গত মাসে জানান, তালেবান এগুলো সুরক্ষিত রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে হাজারো প্রতিশ্রুতির মতো এ প্রতিশ্রুতিও তারা রক্ষা করবে কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি। রহিমি বলেন, জাদুঘরের কর্মীদের, ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলোর সংরক্ষণ নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষিত রাখতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা বন্ধ করা হয়েছে। কবে এই সহায়তা চালু হবে, তা নিশ্চিত নয়। আফগানিস্তানে নিযুক্ত ফ্রান্সের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রতিনিধিদলের পরিচালক ফিলিপ মারকুইস বলছেন, ‘আমরা দম বন্ধ করে আছি। তবে আমার আশা, শিগগিরই পরিস্থিতি বদলাবে।’

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করতেন, এমন অনেক আফগান বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে প্রাণভয়ে লুকিয়ে আছেন দেশেই। অনেকে আবার এ নিয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন। আফগানিস্তানের ঐতিহ্য, পুরাকীর্তি রক্ষায় তালেবানের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই তাঁদের।

এএফপি, বিবিসি অবলম্বনে শুভা জিনিয়া চৌধুরী