
হিরোশিমা আর নাগাসাকির আণবিক বোমা হামলার ভুক্তভোগী হিবাকুশারা (অ্যাটম বোমার শিকার) নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সজাগ করে চলেছেন। পাশাপাশি দুই শহরের দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠান নানা তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে চালানো গবেষণার মাধ্যমে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি পরমাণু বিস্তারের সর্বশেষ পরিস্থিতির বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ নিয়মিতভাবে উপস্থাপন করে চলেছে। হিরোশিমার শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে যথেষ্ট পরিচিতি পেলেও দেশের বাইরে সেভাবে পরিচিতি পায়নি নাগাসাকির পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তি গবেষণাকেন্দ্র। এর একটা কারণ, হিরোশিমার প্রতিষ্ঠানটির তুলনায় এটা কিছুটা দেরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১২ সালে গড়ে ওঠে নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট। সংক্ষেপে যা রেকনা নামে পরিচিত।

গবেষকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছে পরমাণু বিস্তারের বিপদ-বার্তা পৌঁছে দিতে রেকনা প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে পরমাণু অস্ত্রভান্ডার এবং পরমাণু বোমামুখের পরিসংখ্যান তুলে ধরা পোস্টার ছাপিয়ে তা বিলি করছে। ডুমস-ডে ক্লক বা বিশ্বের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার একটি সময় ঘড়ির ছবিও পোস্টারে থাকে। গত দুই বছরে ধ্বংস-ঘড়ির কাঁটা আরও ৩০ সেকেন্ড এগিয়ে গিয়ে এখন মধ্যরাতের মাত্র আড়াই মিনিট দূরে অবস্থান করছে। মধ্যরাতের ঘণ্টা বেজে উঠলেই শুরু হবে এই পৃথিবীর শেষযাত্রার প্রস্তুতি। সে রকম কিছু যেন না ঘটতে পারে তা নিশ্চিত করতেই রেকনার আবির্ভাব। সম্প্রতি টোকিওভিত্তিক বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে রেকনার কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে এর পরিচালক অধ্যাপক তাৎসুজিরো সুজুকি এসব কথা জানান।
তাঁর মতে, তরুণ প্রজন্মকে বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা না গেলে ধ্বংসের হাত থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। তাই শান্তি আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে নগর প্রশাসনের সহায়তায় নাগাসাকি বিশ্ববিদ্যালয় নাগাসাকি ইয়ুথ ডেলিগেশন বা নাগাসাকির তারুণ্যের প্রতিনিধি একটি কর্মসূচি চালু করেছে। কর্মসূচিতে যুক্ত নাগাসাকির তরুণেরা পিস ক্যারাভান নামের শান্তি শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় জাপানের বিভিন্ন জেলায় গিয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করছে। এ ছাড়া বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলন চলাকালে সেখানে উপস্থিত থেকে বিদেশি প্রতিনিধিদের কাছে নাগাসাকির অভিজ্ঞতার আলোকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের বার্তাও এসব তরুণ পৌঁছে দিচ্ছেন।
জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে হিবাকুশাদের হারিয়ে যাওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এখনো যাঁরা জীবিত, তাঁদের গড় বয়স ৮০ বছরের বেশি। জীবিত ব্যক্তিদের মধ্যেও অনেকেই এখন আর সক্রিয় নেই। ফলে এদের সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া শিক্ষাও যেন এদের সঙ্গে হারিয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা হিরোশিমা-নাগাসাকি দুই শহরই এখন উপলব্ধি করছে। নাগাসাকির ইয়ুথ ডেলিগেশন হচ্ছে সেই অনুধাবনের প্রায়োগিক একটি রূপ।
নাগাসাকি ইয়ুথ ডেলিগেশনের তিন তরুণ সদস্য রেকনায় এসেছিলেন বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে সংস্থার কর্মকাণ্ডের পরিচয় তুলে ধরতে। বিশ্বজুড়ে পরমাণু অস্ত্রের উন্মাদনার মুখে তরুণদের একটি অংশ সেই পাগলা হওয়া নিয়ে ভাবছে। এটা দেখে মনে হয়, সবটাই এখনো অন্ধকারে ঢেকে যায়নি। এদের আজকের চেতনা একদিন হয়তো আরও বিস্তৃত হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। আর তাই হিবাকুশারা চলে গেলেও পরমাণু অস্ত্রমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন হিরোশিমা-নাগাসাকি আমাদের ঠিকই দেখিয়ে যাবে।